হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়ন হয়নি ৭ বছরেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এখনো হয়নি স্মৃতিসৌধ
হিরা তালুকদার : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক স্থানসমূহ চিহ্নিত করা হয়নি এখনো। ২০১০ সালের ৮ জুলাই হাইকোর্টের দেওয়া এ সংক্রান্ত একটি রায়ের একটি নির্দেশনাও বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। তবে ওই রায় বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রকল্প প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
উচ্চ আদালতের যেকোনও নির্দেশ বিধি মোতাবেক আইনে পরিণত হয়ে যায়। কিন্তু একের পর এক নানা অজুহাতে সে আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। হাইকোর্টের ওই রায়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সব স্থাপনা অপসারণ করে আন্তর্জাতিক মানের স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের স্থানসহ স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক স্থানসমূহ চিহ্নিত করতে বলা হয়েছিল। অথচ গত ৭ বছরেও হাইকোর্টের নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার।
হাইকোর্টের ওই রায়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক স্থানসমূহ চিহ্নিত করা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত বধ্যভূমি এবং মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সমাধিক্ষেত্র চিহ্নিত করে তা সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক (পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদের হাইকোর্ট বেঞ্চের দেওয়া ওই রায়ে আরো বলা হয়Ñ ‘একটি কমিটি গঠন করে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সামাধিস্থলে এবং বধ্যভূমিগুলোতে মানসম্পন্ন ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন এবং ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সব স্থাপনা অপসারণ করে আন্তর্জাতিক মানের দৃষ্টিনন্দন ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও তা সংরক্ষণ করতে হবে। তবে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগের কোনো স্থাপনা এবং বিদ্যমান মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত স্মারক, ভাস্কার্য, স্মৃতিফলক বা স্তম্ভ এ আদেশের আওতা বহির্ভূত হবে।’ রায়ে এক বা একাধিক কমিটি গঠন করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যেসব স্থান চিহ্নিত করতে বলা হয়েছে সেগুলো হচ্ছেÑ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম গভর্ণর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র ও ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ভাষণের স্থান, ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদে নির্বাচিত সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের স্থান, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐহিতাসিক ভাষণ, ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থান, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তৎকালিন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দেওয়া ভাষণের স্থান। রায়ে শিশুপার্কও বর্তমান জায়গা থেকে স্থানান্তরের কথা বলা হয়।
হাইকোর্টের রায়ে কিছু পর্যবেক্ষণও দেওয়া হয়েছিল। যাতে বলা হয়Ñ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতির জনক। তার সরকারের সময় স্বাধীনতা পদক প্রবর্তন করা হয়। ওই পদক তাকে প্রদান করে প্রকারান্তে তাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। ওই পদক সব সেক্টর কমান্ডারকে তাদের বীরত্বের পুরস্কার স্বরূপ দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে স্থানে আন্তসমর্পণ করেছে সে অংশটিকে স্বাধীনতা উদ্যান বা লিবার্টি স্কয়ার নমকরণ করা যেতে পারে।
এ ব্যাপারে রিটকারির আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু পূর্ণ রায় ঘোষণার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়ার পর দীর্ঘ ৭ বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে আমার এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের আদালত অবমাননার লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছিলাম। এর জবাবে মন্ত্রীপরিষদ সচিব জানিয়েছেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক স্থপনা চিহ্নিত করতে ও সেখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণসহ হাইকোর্টের রায়ের আলোকে একটি প্রকল্প তৈরী করা হয়েছে। যা এখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। মনজিল মোরসেদ আরো বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি জাতীয় সংসদেও বলেছেন যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্মৃতিসৌধ নির্মাণসহ হাইকোর্টের ওই রায় শীঘ্রই বাস্তবায়ন করা হবে।’ মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘১৯৭১ ও ১৯৭২ সালের সেই দিনগুলোতে যারা সেখানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উপস্থিত ছিলেন তাদের অনেকই মারা গেছেন এবং যারা বেঁচে আছেন তারাও বর্তমানে বয়বৃদ্ধ। তাই এখনই যদি এদের দিয়ে ঐতিহাসিক ওই স্থানগুলো চিহ্নিত করা না হয় তাহলে ভবিষ্যতে এটি আর সম্ভব হবে না।’
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ ব্যাপারে বলেনÑ ‘হাইকোর্টের ওই রায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে রায়ের কিছু নির্দেশনা বাস্তবায়নে সমস্যা দেখা দেওয়ায় পুরো রায় বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে। তবে এ সংক্রান্ত প্রকল্পটি শীঘ্রই অনুমোদন পাবে বলে আশা করছি।’
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শাহবাগের বর্তমান জিয়া শিশু পার্কের দক্ষিণ দিকের সীমানা বরাবর স্থানে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক সেনারা আত্মসমর্পণ করেছিলো। আর ওই বছরের ৭ মার্চ বিশাল জনসর্মূদ্রে বঙ্গবন্ধু যে ঐতিহাসিক ভষণটি দিয়েছিলেন, সেই স্থানটি বর্তমান শিশু পার্কের কিছুটা ভেতরে এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তৎকালিন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দেওয়া ভাষণের স্থান শিশু পার্কে দক্ষিণ দিকের সীমানা বরাবর সোরহাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে।