শোকাবহ ১৫ আগস্ট আজ
প্রিয়াংকা আচার্য্য : ‘কাঁদো বাংলার মানুষ কাঁদো/ যদি বাঙালি হও নিঃশব্দে কাছে এসো, আরো কাছে/… এখানেই শুয়ে আছেন অনন্ত আলোয় নক্ষত্রলোকে/ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’ কবি রবীন্দ্র গোপ তার কবিতায় এভাবেই শ্রদ্ধায় আর্দ্র হয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে। বাংলার মধ্যগগনের অনন্ত সূর্যের অস্তমিতের দিন আজ। আজ জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। শুধু তিনিই নন, নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে তার পরিবারের অন্য সদস্যদেরও। ওই ঘোরতর কালরাতে বাঙালি জাতির ইতিহাসে কলঙ্কিত করেছিল সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য। ঘাতকের নির্মম বুলেটে সেদিন ধানম-ির ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক ভবনে শাহাদৎবরণ করেছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য উদিত হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্তের রাজনীতি। ইতিহাসের অমর পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তা আরও বাড়তে থাকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠন নিয়ে বার বার বাধার মুখে পড়েন বঙ্গবন্ধু। এই প্রক্রিয়ায় নিষ্ঠুর ও বর্বরোচিতভাবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয় তাকে। বিশ্বের বুকে ‘বাংলাদেশ’ মানচিত্র এঁকেছিলেন যিনি, দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা তাকেই বাঁচতে দিল না।
সেই রাতে নিষ্ঠুর হত্যাকা-ের শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বেগম ফজিলাতুন্নেসা, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও তাদের স্ত্রী যথাক্রমে সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসেরসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের আরও ২৮ সদস্য। একইদিন ঘাতকের নির্মম বুলেটে প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত, শিশু সুকান্ত বাবু, আরিফ, রিন্টু প্রমুখ। ঘাতকরা সেদিন ৩২ নম্বর বাড়িতে আক্রমণ করে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে বাঙালি জাতির আশা-আকাক্সক্ষার কেন্দ্রবিন্দুকে নস্যাৎ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তখন দেশে না থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ছোট বোন শেখ রেহানা। ৪১ বছর আগের সেই শোকাবহ দুঃসহ স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। তারা বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসি কার্যকরের আশ্বাস দেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদও এ উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন।
আজ সরকারি ছুটি। ৪১ বছরের অধিকাংশ সময়ই দিনটি ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে চরম অবহেলিত। এর মধ্যে মাত্র ১৩ বছর দিনটি সরকারিভাবে শোক দিবস হিসেবে পালিত হয়েছে। আজ জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। সরকারি ও বেসরকারি ভবনে উড়বে কালো পতাকা। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রথম শোক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসে সে সিদ্ধান্ত বাতিল করে। তবে ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে আবারও রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।
বাঙালি জাতির ইতিহাসে অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু এদেশের স্বাধীনতার স্থপতিই ছিলেন না, ভাষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামেই তার ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। এই মহানায়কের জন্ম না হলে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারত না। জাতির জনককে যারা হত্যা করেছিল, আজকের এই দিনে জাতি ঘৃণাভরে তাদের প্রত্যাখ্যান করছে।
২০১১ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ষষ্ঠবারের মতো জাতীয় শোক দিবস পালিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশ আজ তার খুনিদের পদচারণামুক্ত। কিছুটা হলেও কলঙ্ক থেকে মুক্ত হয়েছে জাতি।
সরকারের এক তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪১তম শাহাদৎবার্ষিকী যথাযথ মর্যাদায় এবং ভাবগম্ভীর পরিবেশে দেশব্যাপী জাতীয় শোক দিবস পালনের উদ্দেশ্যে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
আজ জাতীয় শোক দিবসে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনগুলোয় জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতেও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে এবং আয়োজন করা হবে আলোচনা সভার।
জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সারা দেশের মন্দির, গির্জা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রার্থনার আয়োজন করা হবে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার, সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ এবং বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করবে। এ ছাড়া পোস্টার, সচিত্র বাংলাদেশের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ ও বিতরণ এবং বঙ্গবন্ধুর উপর ‘চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধু’ প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হবে।