দুর্নীতির ধারণাসূচকে স্বস্তি হলেও সন্তুষ্টিতে গোল্লা!
মোহাম্মদ আবু নোমান
‘আহারে চ্যাম্পিয়ন হতে পারল না বাংলাদেশ’! দুর্নীতি বাড়ার কথা শুনলে মনে হয় সবাই খুশি হত! ইতোপূর্বে যেমন টিআইবির রিপোর্টে সব ক্ষমতাসীনরা অসন্তোষ ও প্রত্যাখ্যান করেছেন, এবারে সচেতন জনগণও কেউ বলেছেন ‘রিপোর্ট সঠিক না, সরকারের চাপের ভয়ে এই রিপোর্ট’। কেউ রঙ্গ করে বলেছেন ‘এমন নিউজ হুনার আগে আমার মরণ হলো না ক্যারে’?, কেউবা রসিকতা করে বলেছেন, ‘এখন কিছু খচ্চর কইবে টিআইবি আওয়ামীলীগে চালায়, এরাও মনে হয় আওয়ামীলীগে যোগ দিয়েছে’, কেউবা বলেছেন ‘বাংলাদেশের দুর্নীতি তুলনামূলক কমেনি, অন্য দেশের দুর্নীতি অপেক্ষাকৃত বেশী বেড়েছে’ ইত্যাদি। বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণাসূচক (করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স) ২০১৭ অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান আগের বছরের তুলনায় ২ ধাপ অগ্রগতি হয়ে ১৭ তম স্থান (কচ্ছপ থেকেও ধীর গতি) কিছুটা স্বস্তি যৌক্তিক ভাবলেও সন্তুষ্টিতে গোল্লা! একথা ঠিক যে সিপিআইএ দৃশ্যমান কোন পরিবর্তন সুস্পষ্ট না থাকায় দুর্নীতি কমার কথা শুনে বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়ায় উপরোল্লিখিত মত এসেছে। টিআইবির রিপোর্ট যেদিন গণমাধ্যমে এসেছে, সেদিনেরই দেশের বহুল প্রচারিত দৈনিকে হেডলাইন হয়েছে- ‘এত কম টাকা দিলা তাও আবার পুরনো-ছেঁড়া।
ধুর মিয়া কী দেন না দেন বুঝি না। টেকা দিবেনই যেহেতু ভালো টেকা দেন।’ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ঘুষের টাকা নিতে এভাবেই কথাগুলো বলেছেন কুমিল্লা কোতোয়ালি থানার আওতাধীন চকবাজার পুলিশ ফাঁড়ির এসআই আবদুল হক। এর আগের দিনের পত্রিকায় এসেছে- ‘থানায় মাদকের হাট’ কুমিল্লার কোতোয়ালি থানার ওসির প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে চলছে মাদকের এমন বিকিকিনি। যে টাকার ভাগ জেলা পুলিশের ওপরের কর্তারাও পাচ্ছেন। এছাড়াও ইতোপূর্বে পুলিশ ঘুষের টাকা প্রকাশ্যে গুনে গুনে নিয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমে এসেছিল।
সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খেতে বলেছিলেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘নিজেদের লোকদের সমর্থনের কারণে সোনালী ও বেসিক ব্যাংক অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেননি’। বাংলাদেশ সরকার ২০১০-১১ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা সহায়তা দিয়েছে। সম্প্রতি কয়েকটি রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ব্যাংক টিকে থাকার জন্য সরকারের কাছে আবারও মূলধন সংকট মোকাবিলায় ২০ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকার সহায়তা (বেইল আউট) চেয়েছে।
অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি শেয়ার বাজার বুঝি না’, ‘হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে হইচই করার কিছু নেই’। এমনকি ৩ বা ৪ হাজার কোটি টাকা ‘ইটস্্ নাথিং’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। রিজার্ভ চুরির ব্যপারে এফবিসিসিআই সভাপতি সরকারের আস্থাভাজন আবদুল মাতলুব আহমেদ বলেছিলেন, ‘এটা কোনো বিষয় না, অতো বড় চোর নয়, ছেঁচড়া চোর’। এহেন মুহূর্তে টিআইবির এমন রিপোর্টে সবাইকে তাক লাগিয়েছে।
২০১৭ সালের করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশের স্কোর ২৮। তার অর্থ বাংলাদেশ এখনও ন্যূনতম পাসমার্কের ডিজিটে আসেনি। লজ্জাকর ব্যাপার হলো দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে স্বাধীন সার্বভৌম, সুজলা-সুফলা বাংলাদেশের অবস্থান এখনো বিব্রতকরভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ সর্বনিম্ন অবস্থানে। যা কোনো অবস্থাতেই স্বস্তি বা সন্তোষজনক কি? এ বছর একই স্কোর পেয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে তালিকার নিম্নক্রম অনুযায়ী ১৭তম অবস্থানে সম্মিলিতভাবে আরও রয়েছে গুয়াতেমালা, কেনিয়া, লেবানন ও মৌরিতানিয়ার মতো দেশ। আরো চমকপ্রদ খবর হলো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ৬৭ স্কোর নিয়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে ভুটান।
বলা হয় দারিদ্র্যের কারণে অনেকে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়। বাস্তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, শিক্ষিত, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক এবং সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরাই অধিক দুর্নীতিগ্রস্ত। যার স্পষ্ট প্রমাণ ইতোপূর্বে হতদরিদ্রের জন্য ১০ টাকা কেজি দরের চাল লুটপাট। সেখানে যে চিত্র বেরিয়ে এসেছিল তা চরম দুঃখ ও হতাশাজনক। শাসক দলের নেতা-কর্মী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারী কর্মচারী, স্কুল-কলেজের শিক্ষকসহ স্থানীয় প্রভাবশালীদের অনেকেই এই চাল ভাগবাটোয়ারা করে খেয়েছিল। নৈতিকতার অবক্ষয় কোন পর্যায়ে নেমে গেছে তা গবীর, দুঃখি, দুস্থ’, ভিখারী, অনাহারীদের চাল বিক্রির ঘটনা থেকে বুঝা যায়। যাতে বিবেকবান মানুষমাত্রই ঘৃণায় শিহরীত হয়েছিল।
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে ‘দ্য লাস্ট জ্যাকেট হ্যাজ নো পকেট’। অর্থাৎ ‘শেষ পিরানের (কাফনের) পকেট নেই’। বলা হয় যে, মানুষের সাধ মিটবে না সেই পর্যন্ত, যে পর্যন্ত না তার মুখে মাটি পড়বে। অর্থাৎ মৃত্যু হয়ে কবরে না পৌঁছবে। আমাদের দেশের বর্তমান এমপি, মন্ত্রীরাও প্রবাদটি শুনেছেন ও জানেন। তবে ক্ষমতার অন্ধ নেশার ঘোরে যেন তা ভুলে গেছেন। ক্ষমতাসীনরা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দিনবদল ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার কথা বলে থাকেন। কিন্তু আমরা বাস্তবে দেখছি দুর্নীতিমুক্ত তো নয়নি বরং দুর্নীতি হয় না এমন কোনো সেক্টর আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বাংলাদেশের কতিপয় আমলা শ্রেণি ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা অনেকটা হায়েনার মত। এটা এমন একটা দেশ যেখানে ‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’। এরকম একটি দেশে কোনদিনও কি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব? বাংলাদেশের বিদ্যমান কোনো দলই দুর্নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে কি? তাই সাধারণ জনগণের প্রশ্ন- বাংলাদেশে আদৌ সুশাসন নিশ্চিত হবে?
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক/সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ