আন্তর্জাতিক নারী দিবস মজুরি বোর্ড গঠন করায় স্বস্থিতে আছে নারীশ্রমিক, প্রয়োজন কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা
স্বপ্না চক্রবর্তী : ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে বোর্ড গঠিত হওয়ায় অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা লাভের আশায় স্বস্থি বিরাজ করছে পোশাক কারখানায় কর্মরত নারীরা। তবে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে সম্মানের সাথে কাজ করারও নিশ্চয়তা চান তারা।
বিজিএমইএ ও বিকিএমইএ সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মরত ৪০লাখ শ্রমিকের মধ্যে প্রায় ২৬লাখই নারী। পুরুষদের সাথে সমানতালে তারা পোশাক শিল্পের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন দিন রাত। তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের কতা চিন্তা করেই সরকার ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠনের সিদ্ধান্ত নিলেও কর্মক্ষেত্রে নেতৃত্বসহ সব বড় কোনো পদে নারীদের পদচারণা একেবারেই কম। এছাড়া রয়েছে যৌন হয়রানিসহ নানা ধরণের লাঞ্ছনার ঘটনা। জানা যায়, মাত্র ৪শতাংশ নারী সুপারভাইজারসহ কয়েকটি বড় পদে চাকরি করছে। বাকিরা শ্রমিক পদেই কাজ করছেন। এতে করে সহকর্মী পুরুষদের দ্বারা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা।
এ ব্যাপারে গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠন হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। খুব দ্রুত এর বাস্তবায়ন করা দরকার। এছাড়াও নারী দিবসের প্রাক্কালে আমি কর্মক্ষেত্রে নারীদের যৌন হয়রানিসহ অন্যান্য ধরণের লাঞ্ছনা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহ্বান জানাচ্ছি। এ লক্ষ্যে সচেতনতা তৈরিতে বিভিন্ন ধরণের সভা সেমিনারের আয়োজন করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন এই নেত্রী।
এদিকে সম্প্রতি একটি সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. অতনু রব্বানী জানিয়েছেন, তৈরি পোশাক শিল্পের ১০০প্রতিষ্ঠানে সমীক্ষা চালিয়ে আমরা দেখেছি মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ১২শতাংশ ভূমিকা রাখছে পোশাক শিল্প। এ শিল্পের হাত ধরে আসছে রফতানি আয়ের ৮০শতাংশের বেশি অর্থ। তবে এ শিল্পে নারী শ্রমিকেদর প্রাধান্য থাকলেও নেতৃত্বে তাদের ভূমিকা খুবই সামান্য।
অন্যদিকে ‘এস্টেট অব রাইটস ইমপি-মেন্টেশন অব ওম্যান রেডিমেড গার্মেন্টস ওয়ার্কাস’ শিরোনামের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায় পোশাক শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকদের শতকরা প্রায় ১৩ভাগ যৌন হয়রানীর শিকার হচ্ছে। এরমধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার ২০ভাগ। মানসিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছে ৭১ভাগেরও বেশি।
অস্ট্রেলিয়ান ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের আর্থিক সহযোগিতায় ‘কর্মজীবী নারী’ কর্তৃক পরিচালিত এই প্রতিবেদনে উঠে আসে নারী পোশাক শ্রমিকদের কর্মস্থলের পরিবেশ, চাকরির শর্ত এবং কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যসহ অন্যান্য বিষয়গুলো। তাতে দেখা যায়, প্রায় ৩১ দশমিক ৩ ভাগ নারী শ্রমিকের কোনো নিয়োগপত্র নেই। ৫৩ দশমিক ৩ ভাগের নেই সার্ভিসবুক? তবে ৯৮ দশমিক ৭ ভাগের হাজিরা কার্ড আছে।
এছাড়াও, আইনের লঙ্ঘন করে শতকরা ৫০ ভাগকে ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করা হয়। ওভারটাইম করা বাধ্যতামূলক এবং তা দিনে দুই ঘণ্টারও বেশি হয় বলে প্রতিবেদনে প্রকাশ পায়। বলা হয়, বিশ্রামের কোনো সুযোগ পান না ৭০ ভাগ শ্রমিক। ২৫ দশমিক ৩ ভাগ সাপ্তাহিক ছুটি পান না।
নারী শ্রমিকদের ৮৪ দশমিক ৭ ভাগ মৌখিক হয়রানির শিকার হন? ৭১ দশমিক ৩ ভাগ শিকার হন মানসিক নির্যাতনের। ২০ ভাগ শারীরিক নির্যাতনের কথা বলেছেন। আর যৌন নির্যাতন বা হয়রানির শিকার হন ১২ দশমিক ৭ ভাগ। আর এই নির্যাতনের শতকরা ৫২ ভাগের জন্য তারা দায়ী করেছেন পোশাক কারখানার সুপারভাইজারদের। নির্যাতনের শিকার ৩২ ভাগই জানেন না এর বিরুদ্ধে কোথায় অভিযোগ করতে হবে। এছাড়া কর্মস্থলে ডে কেয়ার সেন্টার ও বিশ্রামের জায়গা না থাকা, রাতে কাজের সময় নিরাপত্তা সংকটের কথাও উঠে এসেছে। ৭৪ দশমিক ৭ ভাগ নারী বলেছেন, তাদের রাতের পালায় কাজ করতে হয়।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের প্রধান নাজমা আক্তার বলেন, পোশাক কারখানায় যারা শ্রমিক, তাদের অধিকাংশই নারী। আর যাঁরা সিদ্ধান্ত নেয়, তারা পুরুষ। ফলে নারী শ্রমিকরা নানা ধরনের হয়রানি ও প্রতিকূল পরিবেশের মুখে পড়ে। নারীকে পোশাক কারখানায় নারী হিসেবে নয়, সস্তা শ্রমিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এতে করে তারা সব ধরণের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।