বাসন্তি পূজার ইতিবৃত্ত
আশালতা বৈদ্য
স্বরণাতীত কাল হতে সনাতন ধর্মের সাধনা ও আচারানুষ্ঠান বিভিন্ন ধারায় প্রবাহিত। তন্মধ্যে শাক্ত আর বৈষ্ণব ধারা দুটি পৃথক হলেও উদ্দেশ্য মূলত এক। বেদের যেমন দুটি ধারা একটি কর্মকা- অপরটি জ্ঞান-কা-। কর্ম ও জ্ঞান উভয়ের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরকে লাভ করা যায়। বেদের ধারা বিবিধ উপনিষধ, কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। বেদের ব্রহ্মকেই তন্ত্রশাস্ত্রে ব্রহ্মময়ী মহাশক্তি রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। যিনি সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের কর্তা তিনি শক্তিরূপী চ-ি। বসন্তে তার আগমন বিধায় তাকে বলা হয়েছে বাসন্তী।
যে শক্তি জীবের অন্তরের শক্তিকে জাগ্রত করেন তিনিই চ-ি তিনিই বাসন্তিকা। আর সেই শক্তিই যখন জীবের দূর্গতি নাশ করেন তিনিই দূর্গা। চ-ি মার্ক-ে পুরানের অন্তর্গত। এতে সাতশ’ শ্লোক রয়েছে তাই একে সপ্তসতী নামে অভিহিত করা হয়েছে। শ্রী শ্রী চ-িতে আত্মার শক্তিকে জাগ্রত করার দিক নির্ণয় করা হয়েছে। যথা না হাঁটলে পথ ফুরায় না। সেই রূপ সাধনা না করলে সিদ্ধি লাভ সম্ভব নয়। দুঃখ, দারিদ্র্য, শোক বেদনাময় পৃথিবীতে মূলত কেউ সুখী নয়। সুখ নামের কল্পিত পাখির পিছে আমরা সবাই দৌড়ে বেড়াচ্ছি। কিন্তু সুখ কোথায়? মেধামুনি রাজ্যভ্রষ্ট বিষাদগ্রস্ত মহারাজ সুরথ ও স্বজন কর্তৃক বিতাড়িত সমাধি নামক বৈশ্যকে মহাশক্তি সাধনা পথের মাধ্যমে যথাক্রমে স্বাধিকার ও মুক্তিলাভের উপায় নির্দেশ দেন।
স্বরণাগত শিষ্য তত্ত্ব জিজ্ঞাসু ভক্ত মহারাজ সুরথ ও বৈশ্য মেধামুনির নিকট দেবাসুর সংগ্রামে বার বার পরাজিত দেবগণ কিরূপে আত্মশক্তির সমন্বয়ে মহাশক্তির উদ্বোধন ও বিকাশ সাধন করে পরিণামের নিজেদের স্বাধিকার পুনরূদ্ধার করেছিলেন তা বর্ণনা করেছেন। সুরথ রাজা লক্ষ বলী দিয়ে সিদ্ধিলাভ করেন। মানব হৃদয়ে লাখ লাখ আশা লাখ ফনার চারিদিক বিস্তারিত হচ্ছে। কিন্তু লক্ষস্থির না হওয়ায় সিদ্ধিলাভ হচ্ছে না। কোনো কর্মে সিদ্ধিলাভ করতে হলে, প্রথমে লক্ষ্যকে স্থির করতে হবে। লক্ষ স্থির করে সিদ্ধি লাভের প্রত্যাশায় সাধনা করা চাই। সমস্ত তন্ত্রের সার চ-ির মূল বেদে প্রতিষ্ঠিত। প্রথম চরিত্র ঋগে¦দ স্বরূপা, মধ্যম চরিত্র যজুবেদ স্বরূপা এবং উত্তম চরিত্র সামবেদ স্বরূপা। চ-ি গ্রন্থ তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে দেবী মহাত্ম্যের সূচনা, দ্বিতীয় ভাগে মূল মন্ত্র, তৃতীয় ভাগে রহস্যক্রয়। এখানে পরমাত্মাকে নানান রূপে, নানা ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সাধনার পথে বিঘœ বিপদ দূরীভূত করার জন্য মন অন্তরমুখী করে অভীষ্ট পথে অগ্রসর হতে হয়। নচেৎ মনের মাঝে মায়া প্রভাবে জ্ঞান শক্তিকে আবৃত করে রাখে। মেঘের আড়ালে সূর্য আবৃত হলে পৃথিবী অন্ধকারময় হয়। অজ্ঞানতার অন্ধকারে মানুষ যখন আবৃত, তখন সে সমস্ত কিছুই অন্ধকার অনুভব কমে না। জ্ঞান রূপে হৃদয়ে অবস্থান করেন। চ-ির উৎপত্তি সম্বন্ধে নানা মত প্রচলিত। কোনো কোনো প-িতগণের মতে নর্মদা অঞ্চলে বা উজ্জীয়নীতে ‘শ্রী শ্রী চ-ি’ রচিত। কিন্তু প-িত দক্ষিণারঞ্জণ শাস্ত্রী ঐতিহাসিক যুক্তি সহকারে উক্ত মত খ-ন করেন। তিনি প্রমাণ করেছেন যে সম্ভবত বাংলাদেশেই চ-ির জন্মস্থান। স্বামী বিবেকানন্দ প্রথমে নর্মদা তীরে মহামায়া চ-ির সাধনা করতেন। তিনি চ-ির উৎপত্তি স্থান সম্বন্ধে চিন্তা করতে করতে তন্ময় মহামায়া মায়ের প্রতি অভিমান বশত নর্মদার জলে প্রাণ ত্যাগের উদ্দেশ্যে ঝাঁপ দিতে গেলে দৈববাণী করলেন, ‘তুমি বাংলার পূর্ব প্রান্তে চন্দ্রনাথ তীর্থে গিয়ে তার দক্ষিণ-পূর্বে নাভিগংগা আবিষ্কার কর। ঐ স্থানেই আমার আবির্ভাব হয়েছিলো। এদিক দিয়ে ইতিহাসের পাতা ও ভৌগলিক স্থান লক্ষ্য করলে দেখা যায়, চট্টগ্রাম শহর হতে এগার মাইল দূরে করলাভাঙ্গার পাহাড়ে অবস্থিত মেধাআশ্রম। এখানে বর্তমানেও ক্ষনিকায়া পার্বত্য জলধারা প্রবাহিত। এর পাশেই মেধামুনির পদচিহ্ন নামে পায়ের দাগ রয়েছে।
জগত সৃষ্টি লগ্নে ব্রহ্মা মধু-কৈটব দুই দ্বৈত্যের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে স্বয়ং বিষ্ণুব যোগ নিদ্রা ভঙ্গ করেন। তখন ব্রহ্মা যোগমায়ার স্তব করেন। কৃত্তিবাস কৃতবাংলা রামায়নে রামচন্দ্র ত্রেতা যুগে রাবন বধের জন্য অকাল বোধন করেন। শরৎকালে পূজা করা হয় বলে একে শারদীয়া উৎসব বলা হয়। বসন্তকালে বাসন্তি পূজার নিয়ম রয়েছে। শ্রী চ-ির দ্বাদশ অধ্যায়ে ভগবতী বাক্যে উভয় পূজার নিয়ম রয়েছে। মহাভারতেও দ্বাপর যুগে শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে শক্তিময়ী দূর্গার প্রার্থনা করার উপদেশ দিয়েছিলেন। পদ্ম পুরানে শ্রী চ-ির কাহিনী রয়েছে। কখনো উমা কখনো পার্বতী নামে চ-িকে উল্লেখ করা হয়েছে। সতীরূপে চ-ির স্বামী নিন্দা সহ্য করতে না পেরে দেহ ত্যাগ করেন। সতীর সেই দেহ বায়ান্ন খ-ে খ-িত করার পর তা বায়ন্নটি তীর্থ ক্ষেত্রে রূপ নিয়েছে। আদিকাল থেকেই ভারতবর্ষে শক্তি সাধনার ধারা চলে আসছে। ভারতবর্ষের বাহিরেও তিব্বত, কাতার, চীন, জাভা, ব্রহ্ম দেশ, জাপান এমনকি বৌদ্ধ ধর্মেও শক্তি পূজা অনুপ্রবেশ করেছিলো। মাতৃভাবের সাধক রামপ্রসাদ, শ্রী রাম কৃষ্ণ, বামাক্ষেপা, শর্বানন্দ ঠাকুর, সাধু তারা চরন, শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী ও তৈলঙ্গ ঠাকুর। রামকৃষ্ণদেব বলতেন যিনি উপণিষদের পরব্রহ্ম তিনিই তন্ত্রের মহামায়া। এদিকে রামপ্রসাদ গেয়ে উঠলেন ‘কালিব্রহ্ম জেনে মর্ম ধর্মাধর্ম সব ছেড়েছি’। গীতায় ভগবান শ্রী কৃষ্ণ বলেছেন, আমিই জগতের পিতা ও মাতা। কলিযুগে বৈষ্ণব অবতার শ্রীচৈতন্য ভগবতে ভগবতীর কথা উল্লেখ করেছেন। শ্রী শ্রী চ-ি তত্ত্বে প্রবেশ করতে হলে, বর্তমান যুগের বহু মনিষী ও সাধকদের বিভিন্ন গ্রন্থ প্রনিধানযোগ্য। বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দূর্গ উৎসব, নবীন চন্দ্রের ‘চ-ির ব্যাখ্যা’, সত্য দেবের ‘সাধন সমর’, বিজয় কৃষ্ণের ‘মা আমার কালো কেন’? নজরুলের শ্যামা সঙ্গীত, স্বামী বিবেকানন্দের কালী দ্যা মাদার, অদ্বৈত্যনন্দের ‘দশ মহাবিদ্যা’ উল্লেখযোগ্য। জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম আমি সৈনিক প্রবন্ধে মানুষের মাঝে অন্তর্গত দুটি রূপের কথা উল্লেখ করেছেন। পুরুষের মাঝে ¯েœহ-মায়া-মমতা মাতৃ হৃদয়ের চিত্রকেই তুলে ধরেছেন। নারী জাতিতে তার সৃষ্টিশক্তি কেন্দ্রভূত রয়েছে। মাতৃরূপে ঈশ্বরকে সাধনা সহজ। মায়ের কাছে তার সন্তানদের লক্ষ্য দাবি। ¯েœহময়ী জননী সন্তানের বহু গঞ্জনা সহ্য করেও অসহায় সন্তানকে মমতায় কোলে তুলে সোহাগে জড়িয়ে ধরেন। স্রষ্টার সৃষ্টির মাঝে নিবিড় সম্পর্ক অনুভব করার জন্যই শ্রী চ-িতে মাতৃরূপে ঈশ্বর বন্দনা করা হয়েছে। কুমারী পূজা এক জ্বলন্ত প্রমাণ। সত্য যুগে মধু কৈটবকে বদ করার জন্য বিষ্ণু চ-িকে স্মরণ করেন। ত্রেতা যুগে রাম রাবন বধের জন্য শরৎকালে অকাল বোধন করেছিলেন। দ্বাপর যুগে মা যশোদা কার্তিক মাসে কাত্যায়নীয় ব্রত করেছিলেন। মেধামুনীর আশ্রমে রাজ্য হারা রাজা সুরথ ও সংসার বিতাড়িত বৈশ্য মহামায়ার তত্ত্ব জেনে বসন্তকালে চ-ির পূজা করেছিলেন। বসন্তকালে এই পূজা করেছিলেন বলেই এই দেবীর পূজাকে বাসন্তি পূজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
লেখক: ট্রাস্টি, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট।