নেক আমল দিয়ে পাপের মাশুল
মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম
উলামায়ে কেরাম কিতাবে লিখেছেন, মৃত্যুর পর মানুষের সব কিছু পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। ১. রূহ, যা জান কবজকারী ফেরেশতা আজরাইল আ. নিয়ে নিবে। ২. শরীর, যাকে কীট-পতঙ্গ-পোকা-মাকড় খেয়ে ফেলবে। ৩. হাড্ডি, যাকে মাটি খেয়ে নিঃশেষ করে ফেলবে। ৪. অর্থ-সম্পদ, যা তার ওয়ারিশরা বণ্টন করে নিয়ে নিবে। বাকি রইল ১টি। আর একমাত্র অবশিষ্ট ৫ম ভাগটি হলো, তার নেক আমল। যা তার আমলনামায় থাকার কথা ছিল কিন্তু দুনিয়াতে হকদারদের হক নষ্ট করার ফলে তার সর্বশেষ অবলম্বন নেক আমলও বণ্টন করে নিয়ে নিবে হকদারেরা। আহ! অন্যের হক প্রাপ্যাধিকার আদায় না করায়, অন্যের হক নষ্ট করায় হকদারেরা দেনাদারের, হকনষ্টকারীর নেক আমলও নিয়ে নিবে! আহ! অন্যের হক নষ্ট করে হকদারের হক ফিরিয়ে না-দিয়ে, তার থেকে ক্ষমা না-নিয়ে মারা গেলে বান্দা কী বিপদেরই না সম্মুখীন হবে। নিজের নেক আমল হকদারকে দিয়ে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। পাপের মাশুল দিতে হবে নেক আমল দিয়ে। সারা জীবনের নামাজ-রোজা, হজ-জাকাত, যাবতীয় নেক আমল হকদারকে দিয়ে নিজে হবে নিঃস্ব। সর্বসান্ত। হৃতসর্বস্ব। আবাস হবে জাহান্নাম। আল্লাহ আমাদের পরের হক নষ্ট করা থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
হক অনাদায়ে দুর্ভিক্ষের কবলে বনি ইসরাইল
বান্দার হক নষ্ট করায় চরম দুর্ভোগ পোহানো এক জাতির ঘটনা শুনুন। হক অনাদায়ে চরম দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিল পূর্ববর্তী উম্মত বনি ইসরাইল। দুর্ভিক্ষ দেখা দিল এই সম্প্রদায়ে। চলল একটানা সাত বছর। পিপাসায় অস্থির প্রতিটি মানুষ। জঠর জ্বালায় কাতর। সংগ্রহে রাখা খাদ্যসামগ্রী সব ফুরিয়ে গেছে। ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করতে, প্রাণ বাঁচাতে খেতে শুরু করল গাছের পাতা। এমনকি নিজের ঔরসজাত সন্তানদের জবেহ করে ভক্ষণ করতে লাগল। চোখের শীতল, নয়নমণি আরও কত কি আদুরে শব্দে-ডাকা কলজের ধন প্রিয় সন্তানেরা ক্ষুধা নিবারণে খাদ্যে পরিণত হল। এ কী চরম মুহূর্ত! কী সঙ্কট ও বেদনাবিধুর আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত! এ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছিল তাদের পাপের কারণে। এটা পাপের জাগতিক শাস্তি। এক পর্যায়ে তাদের বোধোদয় হয়। ভাবান্তর ঘটে। বুঝতে পারল কৃতকর্মের ভুলত্রুটি। অনুতপ্ত হল। এ সঙ্কটপূর্ণ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠল। সিদ্ধান্ত নিল সবাই একত্র হয়ে সম্মিলিতভাবে কেঁদে-কেটে প্রভুর কাছে আরজি পেশ করবে। পাপমোচনের প্রার্থনা করবে। আল্লাহর দরবারে নিয়মিত হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সমবেতভাবে পাহাড়ে ওঠে, কেঁদে-কেঁদে, চিৎকার করে-করে দোয়া করতে লাগলো। হে মেহেরবান খোদা! দয়াময় আল্লাহ! ক্ষমাশীল প্রভু! আমাদের মাফ করে দাও। ক্ষমা করে দাও। কী কান্না! কী রোনাজারি! কান্নার রোল পড়ে গেল। উচ্চ স্বরে সবাই কাঁদছে আর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছে।
তখন আল্লাহ তায়ালা মূসা আ. এর কাছে ওহি প্রেরণ করেন, ‘হে মূসা! যারা কান্নাকাটি করছে তাদের আমার এই ম্যাসেজ দিয়ে দাও। তারা যদি আমার ইবাদত করতে করতে, বন্দেগি করতে করতে, শুকনো পাতার মত জরাজীর্ণও হয়ে যায়। তবুও আমি আমার এই সঙ্গত শাস্তি, আজাবে হক উঠিয়ে নিব না। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা হকদারদের হক আদায় না করবে।’
অমার্জিত আচরণে অন্যের হক নষ্ট হয়
শুধু কারও সম্পদ নষ্ট করাই হকদারের হক নষ্ট করা নয়, অন্যায়ভাবে কাউকে গালি দেওয়াও অন্যের হক নষ্ট করার শামিল। কারও সম্মান-মর্যাদায় অন্যায়ভাবে আঘাত করাও তার হক নষ্ট করা। কাউকে অন্যায়ভাবে বিদ্রুপ করাও তার হক নষ্ট করা। কারও মাল নষ্ট করা, কারও দোকান নষ্ট করা, কারও জমিন নষ্ট করা এ সব-ই অন্যের হক নষ্ট করা। ঠাট্টা-বিদ্রুপে, রঙ্গ-রসিকতায় পরিমিতিবোধ ও মাত্রাজ্ঞান বজায় রাখতে হবে। ঠাট্টা-রসিকতার বিষয়ও সত্যাশ্রিত হতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, পরিমিতিবোধ ও মাত্রাজ্ঞান ছাড়িয়ে, স্থান-কাল-পাত্র এর প্রতি খেয়াল না করা রঙ্গ-রসিকতায় মার্জিত রুচিসম্পন্ন কেউ রস গ্রহণ করে না। বরং এতে বিরক্তবোধ করে। কষ্ট পায়। মানুষকে কষ্ট দেওয়া হারাম। মারাত্মক গোনাহ।
লেখক: শাইখুল হাদিস ও প্রিন্সিপাল ইসলামবাগ মাদরাসা
জুমার বয়ান শ্রুতি লিখন; দিদার শফিক