বিশেষ সাক্ষাৎকারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান জঙ্গিবাদের পরিকল্পনাকারীদের মুখোশ যাতে উন্মোচিত না হয়, সে জন্যই কি ফাহিমকে হত্যা করা হলো?
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশিক রহমান
(প্রথম পৃষ্ঠার পর)
অনেকের মতো আমার মনেও সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে, বন্দুক যুদ্ধে নিহতের ঘটনা হয়তো সাজানো। এটা কী তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভিতরেই কি লুকিয়ে আছে এমন কেউÑ যারা জঙ্গিবাদের আশ্রয়দাতা, প্রশ্রয়দাতা, যারা চায় না সরকারের জঙ্গি নির্মূল অভিযান সফল হোক, যারা চায়Ñ সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে। জঙ্গিবাদের পরিকল্পনাকারীদের মুখোশ যাতে উন্মোচিত না হয়, সে জন্যই কী তাহলে শিক্ষক হত্যাচেষ্টায় রিমান্ডে থাকা ফাহিমকে হত্যা করা হলো? এই আশঙ্কাটি কিন্তু এখন আমাদের মনে উদিত হয়েছেÑ দৈনিক আমাদের অর্থনীতিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়াম্যান ড. মিজানুর রহমান।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বন্দুক যুদ্ধের যে ঘটনাসমূহ ঘটছে, তা কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। অতি গুরুত্বসহকারে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। কারা নির্দেশদাতা, কারা এর পেছনে রয়েছে, তাদেরকে জবাদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা খুব জরুরি। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রীয় হেফাজতে যখন কোনো ব্যক্তি থাকেন, তখন যদি অনাকাক্সিক্ষতভাবে অস্বাভাবিক মৃত্যু কারও ঘটে তাহলে তার দায় রাষ্ট্রের ওপরই বর্তায়। কারণ রাষ্ট্র এ ধরনের মৃত্যুর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে ড. মিজানুর রহমান বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে গাপটি মেরে বসে থাকা হয়তো কেউ রয়েছেন, যারা জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং যারা নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে এই অপকর্মটি করেছেন সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য।
তিনি আরও বলেন, এখন কারা এই গাপটি মেরে বসে থাকা মানুষ, তা তো আমি বলতে পারব না। তদন্তের বিষয়। যা বলতে পারি, বন্দুক যুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনাগুলোকে যেন সরকার কোনোভাবেই খাটো করে না দেখে। এসবের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার হওয়া দরকার। তদন্ত দরকার। শুধুমাত্র তখনই প্রকৃত সত্য উদ্্ঘাটন হবে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান আরও বলেন, উদ্বেগজনক শব্দটি খুবই শক্ত একটি শব্দ। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক অবস্থায় এখনো যায়নি। তবে মুক্তচিন্তক, প্রকাশক, হিন্দু, বৌদ্ধ, বিদেশি, ইসলামি চিন্তাবিদ এমনকি পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী হত্যার মতো ঘটনাগুলো ঘটেছে, তারপর রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশা করেছিলাম, আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া আমরা পাইনি। তাৎক্ষনিকভাবে যদি হত্যাকারীদের ধরবার জন্য, শনাক্ত করার জন্য, বিচারে সোপর্দ করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতো, তাহলে হয়তো আজকের এই পরিস্থিতিতে আমরা উপনিত হতাম না।
তিনি আরও বলেন, আমরা বরং উল্টোটা দেখেছি রাষ্ট্রের কাছ থেকে। ব্লগারদের যখন কুপিয়ে হত্যা করা হয়, তখনÑ রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে এমন কিছু বক্তব্য এসেছে, যা প্রকারান্তরে হত্যাকারীদের উৎসাহিত করেছে। যারা প্রগতিশীল, মুক্তচিন্তার ধারক-বাহক তাদেরকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। এরকম আচরণ রাষ্ট্রের কাছ থেকে আশা করিনি।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে ড. মিজানুর রহমান বলেন, সাঁড়াশি অভিযানে হাজারও মানুষকে গ্রেপ্তার পুলিশের ক্ষমতার অতি অপব্যবহার। যদি ধরেও নিই, ১৯৪ জনই জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদেরকে ধরতে গিয়ে যদি ১৩ হাজার মানুষকে আটক করতে হয়, সঙ্গত কারণেই পুলিশের যোগ্যতা, দক্ষতা, পারদর্শীতাকে নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়। কেননা, এমন আচরণ মানবাধিকারের লঙ্ঘন, মানুষের হয়রানি। এরকম কর্মকা- করলে শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, বহির্বিশ্বেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সাংঘাতিকভাবে ক্ষুণœ হয় বলে মনে করি।
মানবাধিকার কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে অভিযোগের প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের বক্তব্য অনেক সময় সরকারের পক্ষে, বিপক্ষেও যেতে পারে। যখন ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে কথা বলি, তখন সন্দেহ করা হয়, আমি কী বিরোধীদলের সুরে কথা বলছি? কারণ সেটা তাদের পক্ষে যাচ্ছে। তখন সরকার দলীয়রা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। নালিশ করেন। যখন আমি জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিই, যেটা সরকারের পক্ষে যায় তখন বিরোধীদল বলে, উনি তো সরকারের চামচা। যখন উভয় পক্ষ থেকেই গালিগালাজ করা হয়, তখন মনে করিÑ আমি বোধ হয় সঠিক পথেই আছি। উভয় পক্ষই থেকেই যখন আমার সমালোচনা করে, উভয় পক্ষের কাছেই আমি গ্রহণযোগ্য, আবার অগ্রহণযোগ্য। এই জায়গাটিই প্রমাণ করে আমি নিরপেক্ষ। অবশ্যই আমরা নিরপেক্ষ। নিরপেক্ষভাবেই আমরা কাজ করার চেষ্টা করি।
ড. মিজানুর রহমান আরও বলেন, একটি জায়গায় কখনোই বলি না আমরা নিরপেক্ষ। সবসময়ই বলেছি, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের যতদিন আমি চেয়ারম্যান, আমরা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের একটি শক্তি। আমরা বলেছি, স্বাধীনতার মূল্যবোধের প্রতি আমাদের একনিষ্ঠ আনুগত্য। বলেছি, বঙ্গবন্ধু আমাদের প্রেরণাÑ এই কথাগুলো বলতে এখনো দ্বিধা করি না। এই সত্য উচ্চারণ আমি সবসময়ই করেছি, এখনো করছি। এই কারণে যদি বলেন, আপনি দলীয়, এটা আপনার বিবেচনার বিষয়। তবে আমি মনে করি, আমার স্বাধীনতা, আমার মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ, স্বাধীনতার চেতনা, আমার জাতির জনকÑ এসব কোনো দলীয় বিষয় নয়Ñ সারা জাতির ব্যাপার। জাতীয় বিষয়বস্তু। জাতীয় বিষয়বস্তুকে দলীয়ভাবে দেখার কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন