অভিজাতরা ব্যবহার না করলেও কদর কমেনি গামছার, কারিগরদের অবস্থা দুর্বিসহ
মতিনুজ্জামান মিটু: অভিজাতরা ব্যবহার না করলেও কদর কমেনি গামছার, তবে প্রকৃত দাম না পাওয়ায় কারিগরসহ সংশ্লিষ্টদের জীবন দুর্বিসহ যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে রয়েছে। অথচ এ যন্ত্রণা অনুভব করার কেউ নেই। নানা কারণে জাতীয় তাত বোর্ডসহ সরকারেরও এ বিষয়ে দেকভাল করার কোনো কার্যক্রম নেই। প্রতিকুল পরিবেশে এখনও বাংলাদেশে বছরে অন্ততঃ হাজার কোটি টাকার ১০ কোটি গামছা বিকিকিনি হয়ে থাকে বলে এই সেক্টরে জড়িত মানুষ জনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে।
দেশের গামছা ও লুঙ্গি সেক্টরের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফয়জুর রহমান চৌধুরী বলেন, একটা নতুন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে জাতীয় তাত বোর্ডের চেয়ারম্যানই ভাল বলতে পারবেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি এখনো গামছা ব্যবহার করি। তবে শহরের বেশিরভাগ মানুষই গামছা ব্যবহার করেনা। গামছা ব্যবহৃত হয় গ্রামে। ঐভাবে গামছা লুঙ্গির জন্য সরকারের আলাদা কোনো কার্যক্রম বা প্রকল্প নেই। এ বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যানও নেই। পশ্চিম বাংলায় গামছা যায় কিনা আমার জানা নেই। গামছার কারিগররা ব্যাংক লোন হয়তো পায়না। তবে আমরা তাঁত বোর্ডের পক্ষ থেকে তাতিদের ঋণ দিয়ে থাকি। বরিশাল, ঝালকাটি, গৌরনদী ও যশোরসহ বিভিন্ন স্থানে গামছা তৈরী হয়।
ঝালকাঠির গনি মিয়ার গামছার খুবই নাম আছে। এর পিচ প্রতি দাম ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা। আমিও এ গামছা ব্যবহার করেছি। তাত বোর্ডের মেম্বর মো. মিজানুর রহমান বলেন, আমি এখন আর গামছা ব্যবহার করিনা। আগের মতো গামছা ব্যবহারের সুযোগ নেই। বাংলাদেশ থেকে ভারতের পশ্চিম বাংলায় কিছু কিছু গামছা যায়।
বাংলাদেশ জুট গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপ্যাল অফিসার মো. তারিক হোসেন বলেন, গামছা ও লুঙ্গি দিয়েই শুরু হয়েছিল পাটের বহুবিদ পণ্য তৈরীর কার্যক্রম। এসময় পাটের গামছা, লুঙ্গি ও তোষকের কাপড় উৎপাদন করা হতো। খসখসে হওয়ার কারণে বাংলাদেশ জুট গবেষণা ইনস্টিটিউটের জেটিপিডিসি’র ওই কার্যক্রম এগোয়নি। রং ও সুতার দামের অত্যাধিক দামের কারণে দেশের গামছা শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত আছে তাদের অবস্থা খুবই করুণ। প্রতি পরিবার বছরে অন্তত তিনটি গামছা ব্যবহার হয়ে থাকে । এই হিসেবে এখানে অন্তত ১০ কোটি গামছা ব্যবহার হয়ে থাকে। মুটে ও অনেক রিক্সা চালকসহ শ্রমজীবিরা কাজের সময় মাজায় গামছা বেঁধে রাখে। মেয়েরা চুল মুছতে বা শুকাতে মাথায় এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের পূণ্য¯œানে বছরে প্রচুর গামছা ব্যবহার হয়ে থাকে। তোয়ালে শুকাতে দেরি হয় তাই অনেকে গামছা ব্যবহারে সচ্ছন্দ বোধ করেন। তবে শহরের বাথরুমগুলোতে সাধারণত গামছা থাকে না। সেখানে তোয়ালে স্থান করে নিয়েছে।
বিভিন্ন পূঁজা ও হিন্দুদের বিয়েতেও অনেক গামছা ব্যবহার হয়ে থাকে। গোসলের সময়, হাত-পা ধুতে গামছা ব্যবহার হয়। বড়, মাঝারি ও ছোট এই তিন ধরণের গামছা দেখা যায়। এছাড়াও পূঁজা এবং বিয়েতে স্পেশাল গামছা তৈরী হয়। বর্তমানে বড় গামছা ৮০ থেকে ১০০ টাকা, মাঝারি ৫০ থেকে ৬০ টাকা এবং ছোট গামছা ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়। পূঁজা ও বিয়ের গামছা ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হয়। একজন কারিগর দিনে ৮ থেকে ১০টি গামছা তৈরী করতে পারে। রং এবং সুতার দাম মিটিয়ে তাদের খুব একটা লাভ থাকেনা। অনেক ক্ষেত্রে লোকসান হয়। শুধু গামছা বানানোর মধ্য দিয়ে তারা চলতে পারেনা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাতিদের জন্য সুতার কোটা দিয়েছিলেন। সেসময় তাতিরা কম দামে সুতা পেত, এখন আর পায়না। তাই এই শিল্প এখন ভাটির দিকে। সরকারের এ বিষয়ে নজরদারি নেই। দেশে যা কিছু উন্নয়ন হয়েছে তার সবই হয়েছে বেসরকারি উদ্যোগে। এ বিষয়ে সরকারের কৃতিত্ব খুবই কম। ব
াংলাদেশ থেকে পশ্চিম বাংলায় গামছা যায়। মুক্তিযোদ্ধা ও অভিজ্ঞ সাংবাদিক আলতাফ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের খুলনার ফুলতলা, কুষ্টিয়ার কুমারখালি, পাবনার শাহজাতপুর, আলমডাঙ্গার মুন্সিগঞ্জ, হালসা, পোড়াদহ, নওগাঁ, সান্তাহারের শাওয়াই, বগুড়ার মহাদেবপুর, টাঙ্গাইল, ভোলতা, বাবুর হাট, গাউসিয়া, কাঁচপুর, নরসিংদি, রুপগঞ্জ, আড়াইহাজার, বারুদি, সোনারগাঁ, ভুলট প্রভৃতি স্থানে গামছা তৈরী হয়ে থাকে। রং ও বুননে খুলতলার গামছা খুবই উন্নত। ২৪ পরগোনার বনগাঁ, বীরভূম, বাকুড়া, বর্ধমানসহ পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন জেলায় বাংলাদেশের ফুলতলার গামছার কদর আছে। পশ্চিম বাংলার বসির হাট ও নদীয়া সহ কিছু কিছু জায়গায় গামছা তৈরি হয়ে থাকে। তবুও বাংলাদেশ থেকে বৈধ এবং অবৈধভাবে প্রতি বছর অনেক গামছা পশ্চিম বাংলার কোলকাতার বড় বাজারে যায়, মতিগঞ্জ ব্রীজের কাছে গামছার হাট বসে। এখান থেকে যায় পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন জেলায়। বাংলাদেশে অনেক তাঁতী এ সেক্টরে জড়িত। তবে তাদের অবস্থা মোটেও ভাল নয়। মহাজনি ঋণে জর্জরিত হয়ে আছে তারা। ব্যাংকের ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা নেই এই সেক্টরে। সংসারে নারি-পূরুষ ও শিশু নির্বিশেষে শ্রম দিয়েও তারা শোষিত এবং বঞ্চিত। তাই এই সেক্টর ক্রমান্বয়ে গুটিয়ে যাচ্ছে।