বেসরকারি ১৫ ব্যাংকের প্রতিটির খেলাপি ঋণ হাজার কোটি টাকা
আরিফুর রহমান তুহিন: সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বেসরকারি ১৫টি ব্যাংকের প্রতিটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে একটি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা যা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। উল্লেখিত ১৫টি ব্যাংক ছাড়া আরও প্রায় ১০টি ব্যাংকের প্রত্যেকটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার অধিক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে সবথেকে বেশি খেলাপিতে রয়েছে চট্টগ্রামভিত্তিক একটি শিল্প পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকা শরীয়াহ ভিত্তিক একটি ব্যাংক। তাদের মোট খেলাপির পরিমান দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের সাড়ে ৫ শতাংশ। মালিকানা পরিবর্তন হওয়া ব্যাংকটিতে কয়েকদফা পরিচালনা পর্ষদের পরিবর্তন হয়েছে। পদত্যাগ করেছে কয়েকজন চেয়ারম্যান। কিন্তু বেড়েই চলছে খেলাপি। জ্যামিতিক হারে তাদের খেলাপি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হিসেবে পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজন লোক রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোকে দায়ি করছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা।
খেলাপিতে থাকা দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মালিকানা পরিবর্তন হওয়া আরেক বেসরকারি এবি ব্যাংক। তাদের মোট ঋণের প্রায় ৭ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে যার আর্থিক পরিমান ১ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। গত বছরের শেষের দিকে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের বড় ধরণের পরিবর্তন আসলেও থামানো যায়নি তাদের খেলাপি। দুর্নীতির কারণে সাবেক পরিচালনা পর্ষদের অনেকের বিরুদ্ধে দুদক আইনি ব্যবস্থা নিলেও তা অনেকটা ধীর গতিতে চলছে। আবার অনেকেই এখনও ব্যাংকটিতে বহাল তবিয়তে রয়েছে যারা অনিয়মে জড়িত এমন অভিযোগ রয়েছে। যদিও বর্তমান কর্তারা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পরিচালক বলছেন, আগের ঋণগুলোই মূলত ক্রমেই খেলাপি হয়ে পরেছে। এছাড়া দূর্নীতিবাজ কেউ এখন আর তাদের সাথে নেই।
বেসরকারি আরেক ব্যাংক আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের খেলাপির পরিমান ১ হাজার ১৭২ কোটি টাকা, মোট ঋণের ৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ। অথচ গত বছরের এই সময়ে তাদের খেলাপি ছিল হাজার কোটির নিচে। ব্যাংক এশিয়ার ১ হাজার ৪৪ কোটি টাকা, মোট ঋণের ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ১ হাজার ৩০ কোটি টাকা, মোট ঋণের ৫ দশমিক ২০ শতাংশ। এক্সিম ব্যাংকের ১ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা, মোট ঋণের ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। আইএফআইসি ব্যাংকের ১ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা, মোট ঋণের সাড়ে ৮ শতাংশ। ন্যাশনাল ব্যাংকের ১ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা, মোট ঋণের ৬ দশমকি ১৭ শতাংশ।
প্রাইম ব্যাংকের ১ হাজার ১৩ কোটি টাকা, মোট ঋণের ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। পূবালী ব্যাংকের ২ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা, মোট ঋণের ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ। সাউথইস্ট ব্যাংকের ১ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১ হাজার ২০১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ। সিটি ব্যাংকের ১ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, অতিরিক্ত খেলাপি হয়ে যাওয়া ব্যাংকগুলোর প্রতি তারা বিশেষ নজর দিচ্ছে। চলছে মনিটরিং। এজন্য ব্যাংকগুলোকে বুঝেশুনে ঋণ প্রদান এবং ঋণ আদায়ের দিকে মনোযোগী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। জুন পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, আদায়ের হার আগের চেয়ে বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেখে ব্যাংকগুলোকে মনিটরিং করে না, দেখে খেলাপি ঋণের হার। ঋণ বিতরণ অনেক বেশি হলে হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ ২ বা ৩ শতাংশও হতে পারে। এ কারণে শতকরা হারই বিবেচনায় নেয়া হয়।
ব্যাংকগুলোর এমন খেলাপি বৃদ্ধির ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর প্রফেসর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতে অনিয়মকারীদের কঠোরভাবে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালাগুলো যথাযথভাবে পরিপালন করা হচ্ছে না। জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যাওয়া টাকা আদায় না হওয়ায় সেগুলো এখন খেলাপি হচ্ছে।