মোনালিসার পাথরমূর্তি
মাহফুজ জুয়েল
হাঁটতে হাঁটতেই একদিন হঠাৎ হুট করেই দেখা হয়ে গেল শুন্যতার সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গেই শুন্যতা হয়ে গেল আমার গল্পের নায়িকা। গল্প করতে করতেই জানলাম, শুন্যতা হেঁটে যাচ্ছিল গন্তব্যহীন গন্তব্যের দিকে। একই পথে হাঁটছিল আমার গল্পের নায়ক ভবঘুরে। ভাগ্য ভালো, ওর সঙ্গে শুন্যতার দেখা হয়ে গেল। দুর্ভাগ্য আমার, দেখা হলো ঠিকই, কিন্তু সমস্ত পথজুড়ে তাদের একটিও কথা হলো না।
শুন্যতা সম্পর্কে ইতিহাসে এরচেয়ে বেশি বা তেমন কিছু জানা যায় না। তবে ইথারে বেশকিছু শব্দ ভাসতে দেখা যায়, যা দেখে ধারণা করা হয়, সে মহাসাগরের তলদেশের মতো রহস্যময় কিছু একটা হবে হয়তো। যখন ঈশ্বর বেঁচেছিলেন এবং যখন তিনি সব জানতেন, তখন স্বয়ং ঈশ্বরও নাকি শুন্যতা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতেন না। ঈশ্বরের মৃত্যুর পর তার পুত্রও এ ব্যাপারে খুব একটা মুখ খুলতেন না। কারণ মুখ খুললেই গল গল করে মূর্খতা বা অজ্ঞতাই বের হয়ে পড়ত। এমনকি ঈশ্বরদের বংশপরম্পরা শত্রু যে বিজ্ঞান, সেই বিজ্ঞানের বংশধরদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাধর পুরুষটিও কেবলমাত্র শুন্যতার কথা বলতে গেলেই প্রায় একই রকম শব্দ বা শব্দমালা ব্যবহার করে ফেলতেন। তবে নায়ক ভবঘুরের পাশাপাশি যখন নায়িকা শুন্যতাকে পৃথিবীর পথে পথে হাঁটতে দেখা যেত তখন সবার কাছেই তাকে অনেক চেনা চেনা লাগত।
আর শুন্যতা সম্পর্কে গল্পটি অনেকটা এরকম:
কোটি কোটি বছর আগে অনিন্দ্যসুন্দর এক গ্রহ ছিল, পৃথিবী। সেখানে আর সব প্রাণের সঙ্গে বাস করত ভয়ংকর প্রজাতির এক আত্মঘাতী প্রাণী। সেই প্রাণীদের মধ্যে একজন, অন্য সবার সঙ্গে, সঙ্গী হয়ে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছিল। তার শরীর ছিল কামনা-বাসনার তৈরি! দেখতে প্রেমপিয়াসী মানুষের মনের মতো অদ্ভুত কিম্ভূত কিমাকার।
অনেক অনেক আগের গল্প তো, তখন প্রায় বানরের মতোই ছিল মানুষ; নারী-পুরুষ ওদের মুখের ভাষা তখনও কিচিরমিচির পর্যায়ের, কিছুতেই মনের ভাব বিনিময়ের মতো নয়; ভালোবাসা প্রকাশের উপযুক্ত নয়। তবে তখনও খুব সহজেই সবাই যার যার মতো করে গাছে উঠতে পারত। একটুখানি ভাব-ভালোবাসা চেনা-জানার পরই সবাই গাছে উঠে পড়ত। তারপর ডাল থেকে ডালে, উঁচু থেকে আরও উঁচুতে, একেবারে মগডালে উঠে বসে থাকত। যাতে কেউ কাউকে ছুঁতে না পারে।
গাছে বসেই একদিন পাথরের ছুরিতে আম কেটে খাওয়ার চেষ্টা করছিল গল্পের নায়ক ভবঘুরে-নামক এক বানর। ঠিক তখনই ঠিক ওই গাছের নিচ দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিল গল্পের নায়িকা, যার নাম শুন্যতা বা অন্য কোনো নামে হয়তো একটু পরেই আমরা তাকে জানতে পারব।
শুন্যতা উদাসী উদাসী এক অনন্যা বিষণœার নাম। সে উদাস চোখে, উদাস মুখে, উদাস হয়ে একা একা হেঁটে বেড়ায়, আলতো পায়। হেঁটে যায় অন্য কোনো গ্রহ, উপগ্রহ বা পৃথিবীরই অন্য কোনো নির্জন অথবা প্রিয়জনসুলভ গাছের উদ্দেশে। এদিকে আগে থেকেই গাছে বসা গল্পের নায়কÑ শুন্যতাকে দেখেই ভীষণ চমকে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গেই তার হাত কেটে যায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয়। রক্তের আগে অবশ্য চাপা আর্তনাদ।
শুন্যতার কান চির টান টান। পিনপতনও সে শুনতে পায়। রোমপতনও সে দেখতে পায়। সঙ্গে সঙ্গেই সে দেখতে পেল নায়ক বানরটাকে। দৃষ্টি দিয়েই সে গাছ থেকে নামিয়ে আনলো তাকে। নিচে নেমেই সে দেখতে পেল লাল টুকটুকে সতেজ সফেন এক রক্তপুকুর।
শুন্যতার কাছে ছিল অদৃশ্য মোহনসুতা। সেই সুতা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই নায়কের কাটা হাতটুকু সেলাই করে দিলো। তারপর মুচকি হেসে রক্তপুকুর সেচতে শুরু করল ওরা। পুকুর সেচে ঝরে পড়া সব রক্ত থেকে বানালো ইতিহাসখ্যাত সব অমর প্রেমিক কবির মন। আর এখানে ওখানে ফোটায় ফোটায় পড়া রক্তফোটা থেকে বানালো বাগান; ফোটালো অসংখ্য রক্তগোলাপ। আর তখনই গল্পের নায়ক বানরটি হয়ে গেল কবি। আর কবি হয়ে তো সে রীতিমতো হতবাক! তার শতকোটি পাখায় পাখায় আনন্দের শিহরণ! এক মুহূর্তেই সে পুরো পৃথিবী চক্কর মেরে ঘুরে এল! আসার পথে শুন্যতার জন্য ঠোঁটে করে নিয়ে এল আকাশ আকাশ ভালোলাগা। এই প্রথম পৃথিবী নামের ওই গ্রহটা কবির অনেক ভালো লাগল।
শুন্যতা তখনও দাঁড়িয়ে ছিল গাছতলায়। তার চোখে-মুখে অলৌকিক মুগ্ধতা! কবি এসে শুন্যতার মুখোমুখি দাঁড়াল। শুন্যতার চোখে চোখ রাখল কবি। শুন্যতা মিষ্টি করে হাসল। কবির মনে হলো এবার কুড়িয়ে আনা সব ভালোলাগাগুলো শুন্যতাকে দিয়ে দিই। কবি ঠোঁট খুলতেই ঝর ঝর করে সব ভালোলাগাগুলো পড়ে গেল… ঝরে গেল মহাশূন্যে! আর প্রচ- ভূমিকম্প-হাসিতে খিল খিল করে হেসে উঠল শুন্যতা। সবকিছু ল-ভ- হয়ে গেল কবির। হাসির শব্দের রেশ শেষ হওয়ার আগেই উধাও হয়ে গেল শুন্যতা।
শুন্যতার উধাও হওয়ার কয়েক হাজার বছর পর আমি একদিন তোমার পাশে বসে ঘাসের মাথায় হাত বুলালাম। মাথা তুলে আঙুল উঁচিয়ে দিনদুপুরে চাঁদ দেখালাম। প্রিয় সংগীতে প্রকাশ্য ইঙ্গিতে তোমাকে আমার ভালোবাসার কথা জানালাম। তা তা বললাম, যা না বলেই বলা যায়। তুমিও শুনলে; যা না শুনেও শোনা যায়! কিন্তু তারপর থেকেই তুমি নীরব হয়ে গেলে। আর আমি অপরাধবোধে জ্বরের মতো ভুগতে লাগলাম। কেমন অসহায় অসহায় নিঃস্ব নিঃস্ব অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হলাম। হৃদয়বৃত্তি চৌর্যবৃত্তির সমার্থক বা ব্যক্তিগত মহাপাপ হয়ে দাঁড়াল। মনস্তাপ বেড়েই চলল সাই সাই করে। অথচ তোমার মতো নীরব থাকা কত নিরাপদ! তোমাকে তখন মোনালিসার পাথরমূর্তি বলে মনে হলো। আর তখনই আমি পাথুরে-পাহাড় খুঁজতে শুরু করলাম। বেশিদূর খুঁজতে হলো না, প্রায় অনায়াসে পেয়েও গেলাম। কেননা, ওটা আমার বুকেই ছিল।
তুমি পাথর খেঁাঁড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছ? আমিই সেই পাথর খুঁড়ছি। দ্য ভিঞ্চি এঁকেছে, আর আমি মূর্তি বানাচ্ছি। পা থেকে শুরু করেছি। কত বছর হলো জানি না। হাঁটু পর্যন্ত উঠতে পেরেছি। ঠুক ঠুক ঠুক ঠুক করে খুঁড়ে চলেছি; আরও অনেকটুকু বাকি। পুরো শরীর গড়ে তোলার পর তোমার মুখের কাজটা শুরু করব। মুখের কাজটাতেই মনে হচ্ছে পুরো শরীরের সমান কষ্ট করতে হবে। পাথরে ফুটিয়ে তুলতে হবে তোমার হাসি-হাসি মুখের যত রহস্যরেখা, চির প্রেমিকের প্রিয় সেই অনন্য অভিব্যক্তি।
সূর্য উঠছে। সূর্য ডুবছে।
আমি আলো আঁধারে শুধু খুঁড়ে চলেছি; খুঁড়ে চলেছি আমার বুকের মধ্যে শুধুই তোমাকে।
লেখক: কবি, সাংবাদিক ও আন্দোলন কর্মী
সম্পাদনা: আশিক রহমান