ব্যাংকিং সেক্টর : অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং উত্তরণের উপায়
ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের প্রধান সমস্যা হলো খেলাপি ঋণ ও ব্যাংক খাতের করপোরেট ব্যবস্থাপনার সংকট। ব্যাংক কোম্পানি আইনের এক সংশোধনীর মাধ্যমে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষেদ একই পরিবারের সদস্যসংখ্যা ২ থেকে ৪ এবং পরিচালনা পষের্দ সদস্যদের মেয়াদ ৬ থেকে ৯ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধি করার ফলে করপোরেট ব্যবস্থাপনার সংকট আরও ঘনীভূত হবে।
দেশের মুদ্রানীতি নির্ধারণ, পরিচালনা ও ব্যাংকিং খাতকে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, উল্টো বিএবি তার সাম্প্রতিক কাযর্কলাপের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংককে নিয়ন্ত্রণ করছে। এটা সম্ভব হয়েছে তিনটি কারণে। আমাদের দেশে বিভিন্ন নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠিত হলেও এদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া হয় না। দ্বিতীয়ত, প্রায়ই এসব সংস্থায় অমেরুদ-ী ও জি হুজুর-টাইপের প্রধান নিয়োগ প্রদান করা হয়ে থাকে, যারা নিরপেক্ষভাবে সংস্থা পরিচালনার পরিবর্তে ক্ষমতাসীন ও তাদের ঘনিষ্ঠ মহলের হুকুম তামিলে ব্যস্ত থাকেন। সর্বোপরি দেশের আথির্ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত সব প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন অথর্মন্ত্রী। তার দৃঢ়তা, দূরদশির্তা ও সরকারপ্রধানের বিশ্বাসভাজনতা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তার অন্যথা হলে আথির্ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিভাবকহীন হয়ে পড়বে এবং যাদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা ছিলো, তারাই উল্টো নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে। এখন তারা মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি সবকিছুই নির্ধারণ করছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো দখল ও তাদের বিধিবদ্ধ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিণতি আমরা জানি। ১৯৯৬ ও ২০১১ সালের শেয়ার মার্কেটবিপর্যয়ের প্রধান কারণ ছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা দখল বা বাংলাদেশ সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের ব্যথর্তা, যার ফলে লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী সবর্স্বান্ত হন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যথর্তার কারণেই রিজার্ভ চুরি, ব্যাংক দখল, বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে;।
এখানে, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অবশ্যই আলোচনা দাবি রাখে সেটি হচ্ছে ঋণগ্রহীতা নিবার্চনে ব্যাংকগুলো কি সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে। ব্যাংকের ঋণ প্রদানের প্রায় শতকরা নব্বই ভাগ তহবিল আসে জনগণের আমানত থেকে। সে কারণে ব্যাংক থেকে বিতরণকৃত সব ঋণ যাতে সময়মতো ফেরত আসে সে জন্য সর্বাধিক গুরুত্বারূপ করা ব্যাংকের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের উপরোক্ত গাইডলাইনসে বলা হয়েছে, ব্যাংক থেকে ঋণ প্রদানকালে সঠিক গ্রাহক নির্বাচন, গ্রাহকের ব্যবসায়িক অবস্থা, সুনাম, ঋণ পরিশোধে গ্রাহকের সামর্থ্য এবং ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে ভালো জামানতের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। যেসব গ্রাহকের ব্যবসার টার্নওভার ভালো, বাজারে যথেষ্ট সুনাম রয়েছে, ঋণ পরিশোধে খুবই যতœবান, জামানত নিষ্কণ্টক, মূল্যবান এবং সহজে বিক্রয়যোগ্য সেসব গ্রাহক ভিন্ন অন্য কাউকে ঋণ দেয়ার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংক হতে ব্যাংকসমূহের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা যুগোপযোগী করার জন্য পর্যাপ্ত নীতি সহায়তা প্রদান করার পরও ব্যাংকসমূহ এর যথাযথ পরিপালন নিশ্চিত করতে সামর্থ্য হচ্ছে না। ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব সর্বাধিক হলেও এক্ষেত্রে পরিপালনের হার সর্বনিম্ন। ঋণের যথাযথ ঝুঁকি বিশ্লেষণের মাধ্যমেই ব্যাংকের বিনিয়োগ ঝুঁকিকে সর্বনিম্নœ মাত্রায় বজায় রাখার নির্দেশনা থাকলেও উদ্যোক্তার ঋণ পাবার যোগ্যতা, ঋণ চুক্তি, গ্রাহকের তারল্য প্রবাহ, চার্জ সৃষ্টি, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইউনিট কর্তৃক প্রস্তাবিত ঋণ হিসাব মূল্যায়নের যথার্থতা যাচাই, ঋণ আবেদনের যথার্থতার দিকে দৃষ্টি রেখে ঋণ প্রস্তাব বিবেচনায় নেয়া, সম্পদ ও জামানতের সঠিকতা ও যথাযথ মূল্যায়ন, ঋণের প্রকৃতি ও পরিমাণ, ঋণের উদ্দেশ্য, ঋণ কাঠামো, ঋণের মেয়াদ, ঋণের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইত্যাদি বিশ্লেষণ ছাড়াই ঋণ প্রদান করা হয়। লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক