মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করাই সরকারের দায়িত্ব
মোস্তাফিজুর রহমান রাসেল, কানাডা থেকে
১ . ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর সারা দিন ভোটের পর রাতে যখন ফলাফল ঘোষণা শুরু হলো, আমি এবং আমার বন্ধুরা সবাই মিলে টেলিভশনে ফলাফল দেখছিলাম আর নানা রকমের মন্তব্য করছিলাম। অনেকগুলো মন্তব্যের মধ্যে একটা ছিলো এইরকম যে, এত বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মহাজোট সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তারা হয়ত শুধু ইচ্ছা করলেই একটি দুর্নীতিমুক্ত, জবাবদিহিমূলক এবং যুগোপযোগী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবেন যেগুলোর অভাবে সেদিন ভোটাররা চারদলীয় শরিকদল থেকে দ্বিতীয়বারের মত তাদের মন তুলে নিয়েছিলো। সেই আশা আর বিশ্বাস নিয়েই সেইদিন মানুষ মহাজোটকে ক্ষমতাসীন করেছিল। পরিবর্তনের কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে ঘুরে ফিরে সেই তিনটি মৌলিক শব্দেরই আবির্ভাব ঘটে। দুর্নীতিমুক্ত, জবাবদিহিমূলক এবং যুগোপযোগী সমাজ ব্যবস্থা। চেতনা আর আবেগে ভরা বাংলাদেশের মানুষের এই শব্দ তিনটির ইচ্ছার ব্যাপ্তি আর ব্যপকতার কারণেই বার বার সরকার পরিবর্তন হচ্ছে। রাজনীতি বিশেষজ্ঞরাও একই মত পোষণ করেন।
২ . পৃথিবীর সব দেশেই কম বেশি দুর্নীতি হয়, কিন্তু আমাদের দেশে যা হয় তা আমাদেরকে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় হওয়ার মত অবস্থা তৈরী করে দেয়। আর সেই অভিশাপ থেকে মুক্তির প্রচেষ্টায় জনগণ বার বার নিঃশ্বাস ফেলে যাচ্ছে। কিন্তু ভাগ্যের বিধি বলে কথা। তবে আমাদের দেশের মানুষ বিশ্বাস করে প্রত্যেকেই তার নিজ জীবনের ভাগ্যের স্থপতি। আর সেই প্রচেষ্টায় বার বার পরিবর্তন যদি ভালো কিছু হয়। ক্যান্সাররূপী দুর্নীতির ব্যপকতায় পদপিষ্ট হয়ে মানুষ আজ দিশেহারা। কোথায় নেই দুর্নীতি! শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ভূমি অফিস থেকে শুরু করে প্রশাসনের সর্বোচ্চ ইউনিট পর্যন্ত। আর দিন দিন পরিবেশ এবং প্রতিবেশগত কারণে আমাদের জিন বৈশিষ্টে দুর্নীতির সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করছে। একজন সাধারণ মানুষের মন্তব্য, সুন্দরবনের যে বাঘ, আফ্রিকার যে সিংহ, তাদেরওতো ক্ষুধার একটা শেষ আছে, তারাও ক্ষুধা না লাগলে, নাগালের মধ্যে পেলেও কোন পশু-পাখী হত্যা করে না। আমাদের দেশের এইযে ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজরা, এদের ক্ষুধা কি পেটে নাকি চোখে, আর এর শেষ কোথায় ; নাকি সমগ্র পৃথিবীটা ওদের গলায় বেঁধে দিলে, তারপরও উঁকি দিয়ে দেখবে, ওদিকে কিছু বাকী রয়ে গেল নাকি?
এই সাধারণ ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া কি প্রমাণ করে না যে প্রথম মৌলিক শব্দটি মানুষের যথাযথ এজেন্ডা? মানুষ চায় সেই সমাজ ব্যবস্থা যেখানে যোগ্যতা এবং মেধার মূল্যায়ন হবে, হাসপাতালে বিনা হয়রানিতে সুচিকিৎসা পাবে, জাল দলিল করে ভূমি বেদখল থেকে রক্ষা পাবে, থানায় গিয়ে অযথা হয়রানি হবে না , আদালতে ন্যায় বিচার পাবে যেখানে প্রতিটি মানুষের নাগরিক অধিকার সংরক্ষিত থাকবে। আর সেই কারণেই পরিবর্তন।
৩ . জবাবদিহিতা যে কোনো রাষ্ট্রের কার্যকলাপ সুপরিকল্পতভাবে পরিচালনা নিশ্চিত করে। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে না পারলে দায়িত্বহীনতা বেড়ে যায়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সৃষ্টি হয়। কাজের গতি হ্রাস পায়। যখনই এই নিরেট সত্যগুলো অস্বীকার করা হয় বা তার ব্যত্যয় ঘটে তখনই সমাজে নৈরাজ্য আর বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আমাদের দেশে লোভ, স্বজনপ্রীতি আর দলীয়করণের ভিড়ে এই অকপট মূলমন্ত্রটি ঢেকে যাওয়ার মত অবস্থায়। একবার ভাবুন তো, প্রবাসীদের রেমিটেন্স যদি দেশে না আসত দেশের কি অবস্থা হত ? শুধু অনুমান করুন, গত এক বছরে ১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশে আসছে কেবলমাত্র প্রবাসী আয়ের মাধ্যমে। আমার কাছের একজন পরিচিত প্রবাসীর কাছ থেকে জানলাম, মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় ৭৫% মানুষ নাকি হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠায় যার কোনো প্রকৃত হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকে নেই। সেই পরিমাণ অর্থ দিয়ে যারা দেশের অর্থনীতির মেরুদ- ঠিক রেখেছে তাদেরই কিনা দেশে বিদেশে নিয়মিত হেনস্তা হতে হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যাদের দায়িত্ব অবহেলার কারণে এই সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে তাদেরকে কখন ও জবাবদিহি করতে হয় না, তাদের কখনো চাকরি যায় না কিংবা চাকরি হারানোর ভয় থাকে না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে, গার্মেন্টস শিল্পের কল্যাণে দেশের প্রবৃদ্ধি বছরে শতকরা ৫ থেকে ৭ ভাগ, সেই গার্মেন্টস কর্মীদেরই নানাভাবে হেনস্তা হতে হয়। তাদের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা তথা নিরাপত্তা আমরা দিতে পারি না। তাদের সামান্য দাবিটুকু সরকার পূরণ করতে পারেন না। যে দুটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে কিংবা দেশের প্রচুর সম্ভাবনা সেই গার্মেন্টস শিল্প আর প্রবাসীদের অবমূল্যায়ন প্রতিনিয়ত হয়েই যাচ্ছে নানাভাবে।
৪ . বিশ্বায়নের যুগে যুগোপযুগী সমাজ গঠন প্রতিটি সরকারের দায়িত্ব এবং কর্তব্য। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে সারা বিশ্ব এগিয়ে চলেছে। যে সমাজ ব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, বিচারের নামে প্রহসন চলে তাকে কি আর যুগোপযুগী সমাজ ব্যবস্থা বলা যায়? আমাদের সমাজে এখনো মেয়েরা পিছিয়ে যার অর্থ হচ্ছে, আমাদের সরকারগুলো এখনো এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি, যদিও প্রচারের সময় অনেক বেশি বলে থাকেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটি তা হলো, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে যদি তার ফলাফল শূন্য হয় তাহলে সেই ব্যবস্থার পরিবর্তন করে আধুনিক এবং যথাযথ করতে হবে। তথ্য প্রযুক্তির যুগে সমাজের সর্বস্তওে এর সুফল এখনো নিশ্চিত না। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কথাটা প্রথমে অনেক জনপ্রিয়তা পেলেও এখন অনেকেই কৌতুক হিসেবে ব্যবহার করছে।
মৌলিক শব্দগুলিই দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার। এই মৌলিক অধিকার গুলো নিশ্চিত করাই পরিবর্তিত সরকারের দায়িত্ব। কে জানে নতুন সরকার দেশের মানুষের জন্য কী নিয়ে আসবে? তবে দেশের মানুষের ভাগ্যে মৌলিক পরিবর্তন কে করবে? নতুন সরকার নাকি দেশের জনগণ? সম্পাদনা : সালেহ্ বিপ্লব