৬৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ এখন সংগঠিত রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম আ. লীগের
দীপক চৌধুরী : আজ ২৩ জুন, আওয়ামী লীগের ৬৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৪৯ সালের এই দিনে পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে এই দলটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রসার ঘটে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ দেশে পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সব আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে আওয়ামী লীগ। ১৯৬৬ সালে ছয় দফাভিত্তিক বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ও ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে সাফল্যের পথ ধরে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জনগণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ রায় দেয়। ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধের পর ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর পাল্টে যায় দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট। পরে দীর্ঘ সময় ধরে দলটি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। দীর্ঘ ২১ বছর আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে পরাজয় এবং ২০০৭-এর ১১ জানুয়ারির পর আরেক দফা বিপর্যয় কাটিয়ে দলটি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তিন-চতুর্থাংশ আসনে বিজয়ী হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দলটি টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বাণীতে আওয়ামী লীগের সংগ্রামী ও ত্যাগী ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেন, ভবিষ্যতেও আওয়ামী লীগ এ দেশের জনগণের পাশে থাকবে। দেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত করবে।
১৯৯০-পরবর্তী সময়ে মানুষ অবাধে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলেও তা কৌশলে বা অতিকৌশলে কেড়ে নেওয়া হয়েছে মানুষের সেই অধিকার। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে পরাজিত দলগুলো নিজেদের পরাজয়ের ব্যাখ্যা দিয়েছে। তবে এটাও সত্য ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সুকৌশলে হারানো হয়েছে বলে দলটি মনে করে। এর ব্যাখ্যা-বিবৃতি বহুবার দিয়েছেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। নির্বাচনি প্রক্রিয়া হোঁচট খেয়েছে বারবার। ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ হয়েছে দুই দলে অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে। বহু মানুষের প্রাণ গেছে। বহু মানুষ, গরু-বাছুরকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলে সড়ক-রাস্তা অবরোধ করার নামে সন্ত্রাস করা হয়েছে। এর নেতৃত্ব দিয়েছে বিএনপি-জামায়াত জোট।
২০১৩ সালে পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে যেখানে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সব প্রার্থীই পরাজিত হয়েছিলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা থেকে অনেকটা ছিটকে পড়েছে। বিএনপি এরপর মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছে কিন্তু তারা নিজেদের ব্যর্থতায়-কোন্দলে কোণঠাসা হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হতে পারে, এমন কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম দেশে এখন আর নেই। এক সময় বিএনপি ছিল আওয়ামী লীগের বিকল্প। আজ দলটি বিতর্কিত এবং বিপর্যস্ত।
আনুষ্ঠানিকভাবে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’-এর যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। এই সালের এই দিনে যখন আওয়ামী লীগ ভূমিষ্ঠ হলো, তখন কে ভেবেছিল যে এই দলের হাত ধরে একদিন বাংলাদেশ মুক্ত হবে? আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হবো।
ঢাকার নবাবপুরে মুসলিম লীগের কর্মীরাই আওয়ামী লীগ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম লীগকে একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। ঢাকার কে এম দাস লেনের ‘রোজ গার্ডেনে’র দোতলার হলঘরে আজকের এই দিনে ৬৭ বছর আগে ২৫০ থেকে ৩০০ প্রতিনিধির এক সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ৪০ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়।
ইতিহাসের পাতা থেকে জানা গেছে, ‘আওয়ামী লীগ’ নামটা প্রস্তাব করেছিলেন মওলানা ভাসানী। প্রথম কমিটির নির্বাহীদের মধ্যে ছিলেন মওলানা ভাসানী (সভাপতি); আতাউর রহমান খান, সাখাওয়াত হোসেন, আলী আহমেদ খান, আলী আমজাদ খান ও আবদুস সালাম খান (সহ-সভাপতি); শামসুল হক (সাধারণ সম্পাদক); শেখ মুজিবুর রহমান (যুগ্ম সম্পাদক); খন্দকার মোশতাক আহমদ, এ কে এম রফিকুল হোসেন (সহ-সম্পাদক) এবং ইয়ার মোহাম্মদ খান (কোষাধ্যক্ষ)। শেখ মুজিব তখন ‘নিরাপত্তা আইনে’ জেলে আটক ছিলেন।
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ১৯৫২ সালে শেখ মুজিব দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৫৩ সালে দলের প্রথম কাউন্সিল সভায় শেখ মুজিব সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ভাসানী-মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দ্রুত দেশের আনাচে-কানাচে সংগঠন গড়ে তোলে এবং ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ তখন শেরেবাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বে ‘যুক্তফ্রন্ট’ করেছিল। ফজলুল হকের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এবং আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ক্ষমতার সম্মিলনে এই নির্বাচনে মুসলিম লীগ ধরাশায়ী হয়।
১৯৫৫ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল সভায় দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে একে একটি অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী দলের একটি অংশ নিয়ে বেরিয়ে যান এবং ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ (ন্যাপ) নামে নতুন সংগঠন তৈরি করেন। বলা যায়, তখন থেকেই আওয়ামী লীগে শেখ মুজিবের নিরঙ্কুশ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শেখ মুজিব আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ছয় দফা রূপরেখা ঘোষণা করলে এ দেশে রাজনীতির ব্যাকরণ আমূল পাল্টে যায়। এর ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর ডাকে ১৯৭১ সালে ‘বাংলাদেশ’ নামের একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। স্বাধীনতার জন্য এ দেশের সাধারণ মানুষকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে।
কর্মসূচি
ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গৌরবসমৃদ্ধ আওয়ামী লীগের ৬৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের লক্ষ্যে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে দলটি। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সূর্য উঠার সাথে সাথে দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন, পায়রা উন্মুক্ত ও বেলুন উড়ানো এবং বেলা ২টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভা। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে সভাপতিত্ব করবেন।