শূন্যশুল্কে আমদানির ছদ্রাবরণে বাড়ছে অর্থ পাচার ৬ মাসে এসেছে ৮১ হাজার ২৬২ কোটি টাকার পণ্য
আবু বকর : শূন্যশুল্কে আমদানির ছদ্রাবরণে বাড়ছে অর্থ পাচার। ৬ মাসে বেড়েছে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শূন্যশুল্কে ৮১ হাজার ২৬২ কোটি টাকার পণ্য এসেছে। যার পরিমাণ গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিলো ৬৫ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ শূন্যশুল্কের পণ্য আমদানি বেড়েছে ২৪ শতাংশ। অর্থের পরিমাপে যার পরিমাণ ১৫ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা। অথচ আলোচ্য সময়ে সার্বিক আমদানি বেড়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ। মূলত দেশে শূন্যশুল্কে যেসব পণ্যের আমদানি দেখানো হয়েছে বাস্তবে দেশে ওই ধরনের পণ্যের চাহিদা কমেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। ফলে অর্থনীতিবিদদের মতে শূন্যশুল্কে এই আমদানির ছদ্রাবরণে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বর্তমানে ৩২৮ ধরনের পণ্য আমদানি করতে কোনো শুল্ক দিতে হয় না। শূন্যশুল্কের তালিকার অধিকাংশই খাদ্যপণ্য। এর মধ্যে চাল, ডাল, আটা, ময়দাসহ বেশ কিছু নিত্যপণ্যে নাম মাত্র অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাকস রয়েছে। মানুষের মৌলিক চাহিদার কথা বিবেচনা করে এসব পণ্যে সরকার শূন্যশুল্ক সুবিধা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, সারা পৃথিবীতেই যে পদ্ধতিতে বেশি অর্থ পাচার হয় তার অন্যতম হল ট্রেড (আমদানি-রফতানি) প্রক্রিয়ায়। তবে আলোচিত সময়ে শূন্যশুল্কে আমদানির ছদ্রাবরণে অর্থ পাচার হয়েছে কিনা তা এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কারণ এই সময়ে রপ্তানির পরিমাণও বেড়েছে। ফলে রপ্তানিমুখী শিল্পে ব্যবহৃত শূন্যশুল্কের কাঁচামাল এবং যন্ত্রপাতির আমদানিও বেড়েছে। যেসব ব্যাংক শূন্যশুল্কের আমদানি এলসি প্রদান করেছে ঐসব এলসি নিষ্পত্তির পর ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম পর্যালোচনা শেষে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট মতামত দেয়া যাবে।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, শূন্যশুল্কে আমদানির ছদ্রাবরণে অর্থ পাচারের আশঙ্কা অমূলক নয়। তবে এখানে আরো দুটি কারণ হতে পারে। এক, শূন্যশুল্কের মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অন্য পণ্য আমদানিও হতে পারে। দুই, ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হয়ে থাকতে পারে। সাধারণত যেসব পণ্যে কম শুল্ক থাকে, ওই পণ্য আমদানির আড়ালে বিদেশে অর্থ পাচার হয়। কারণ সরকারকে কোনো ধরনের রাজস্ব না দিয়েই টাকা নেয়া যায়। আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারের বিষয়টি দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছি। সম্প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টেও বিষয়টি চলে এসেছে। ফলে সরকারের অবশ্যই তদন্ত করা উচিত। কারণ এই সময়ে দৃশ্যত বিনিয়োগ কমেছে। তার মতে এ ধরনের পণ্যের আড়ালেই সাধারণত অর্থ পাচার হয়। এই প্রক্রিয়ায় অর্থ পাচার রোধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আরো তৎপর হতে হবে। প্রয়োজনে তাদেরকে এলসি প্রদানকারী ব্যাংকগুলোর সাথে কথা বলে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক, ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, হঠাৎ করে এ ধরনের পণ্য আমদানির বিষয়টি রহস্যজনক। কারণ বর্তমানে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কোনো কোনো খাদ্য রপ্তানির কথা ভাবা হচ্ছে। এরপরও আমদানি বাড়ার বিষয়টি পরিষ্কার নয়। কাগজে-কলমে পণ্য আমদানি দেখানো হলেও বাস্তবে ওই পণ্য আসছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা উচিত। টাকা পরিশোধ করার পরও পণ্য হস্তান্তর না করার কয়েকটি ঘটনা ধরা পড়েছে। এর অন্যতম হল ক্রিসেন্ট গ্রুপ কেলেঙ্কারি।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, পাঁচভাবে দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। এর মধ্যে বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমেই পাচার হচ্ছে বেশি। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) এবং রফতানিতে মূল্য কম দেখানো হয় (আন্ডার ইনভয়েসিং)। অর্থাৎ কাস্টমসকে ভুল তথ্য দিয়ে অথবা কাস্টমসকে ম্যানেজ করে আমদানি-রপ্তানির প্রকৃত দাম গোপন করা হয়। এক্ষেত্রে যে সব পণ্যে শুল্ক নেই, সে ধরনের পণ্যের মাধ্যমে টাকা পাচার করা সহজ হয়। সম্প্রতি এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনা ধরা পড়লে এ নিয়ে তদন্ত চলছে। এছাড়া হুন্ডি ও অন্য মাধ্যমে বিদেশে লেনদেন, সরাসরি ডলার নিয়ে যাওয়া এবং ভিওআইপি ব্যবসার মাধ্যমেও অর্থ পাচার হচ্ছে।
গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও বেড়েছে ১৪ শতাংশ। একই সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে দশমিক ৩১ শতাংশ। শিল্পের কাঁচামালের আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ, এ শুল্ক দিয়ে ১ হাজার ১৭৭ ধরনের কাঁচামাল আমদানি করা যায়। আর ৬৬২ ধরনের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ১ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। নির্বাচনকালে ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ না করার কারণে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। এ সময় শিল্পের উৎপাদনও কমেছে। অথচ রহস্যজনকভাবে কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে। যেখানে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে, সেখানে কাঁচামাল আমদানি বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা। সম্পাদনা : রেজাউল আহসান