অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখে বহুসংস্কৃতি ভিত্তিক জনসমষ্টি
ড. কিউ আর ইসলাম
জনসমষ্টির বৈচিত্র্য দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। জনসমষ্টি গড়ে ওঠে জাতি, উপজাতি, গোষ্ঠী, বংশ, বর্ণ, ধর্ম, কৃষ্টি ও ভাষাগতভাবে। অধিকতর অগ্রবর্তী সমাজে বিভিন্ন দক্ষতার মানুষের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
সমৃদ্ধ গণতন্ত্রের দেশগুলো বিভিন্ন সংস্কৃতি ও পশ্চাৎপটের মানুষগুলোকে উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত হওয়ার সুযোগ দিয়ে অর্থনীতিকে মজবুত করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে সবাইকে একতাবদ্ধ হয়ে দেশের উন্নয়নে নিয়োজিত হওয়ার মন ও মানসিকতা তৈরি করেছে। বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে মানুষ অন্য প্রান্তে গিয়ে নতুন দেশের বাসিন্দা হয়েছে। উন্নত দেশগুলো দক্ষ ও প্রতিভাবানদের সুযোগ দিয়ে থাকে। এসব দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদেশী ছাত্ররা অধ্যয়ন করে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, শিল্প প্রসার ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ক্যাটালিস্ট হিসেবে জড়িত হয়ে আসছে। বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তি বা আইটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণে দক্ষতার সঙ্গে অবদান রেখে আসছে।
আমেরিকাকে সমৃদ্ধিশালী হতে প্রায় দেড়শ বছর ধরে গঠিত মিশ্র জনসমষ্টি বিশাল ভূমিকা রেখেছে। বিপুলসংখ্যক অভিবাসী আগমনের মধ্য দিয়ে আমেরিকা বিশ্বে অন্যতম সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। স্বল্প থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সফলতা অর্জনে অভিবাসীরা বলিষ্ঠ ও ইতিবাচক প্রভাব রেখে আসছেন। অভিপ্রয়াণ আমেরিকার জনসমষ্টিকে ব্যাপকভাবে পুনর্গঠন করে। গত দুই দশকে আমেরিকায় আসা অভিবাসীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশের জন্মস্থান ছিল শুধু এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ। আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে তার দেশের দক্ষিণ সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণে অনড়। এ নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দল, রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভিন্ন মতের সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য, আমেরিকায় সাদা বর্ণের সংখ্যা আনুপাতিক হারে কমছে।
গত শতাব্দীর প্রথম দশকেও মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ ছিল সাদা মানুষ। এদের মধ্যে ১ শতাংশের বেশি ছিল হিস্পানিক-খ্যাত স্প্যানিশ ভাষী বা এদের বংশধর। এক শতাব্দী পর ২০১০ সালে হিস্পানিকদের সংখ্যা ১৬ শতাংশের ওপর বৃদ্ধি পায়। হিস্পানিকবহির্ভূত সাদা মানুষের সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশের নিচে চলে আসে। একই সময়ে আফ্রিকান-আমেরিকান, এশিয়ান-আমেরিকানসহ অন্যদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। এদিকে গত শতাব্দীর শেষ দশক এবং এ শতাব্দীর প্রথম দশকের মধ্যে সাদাদের মধ্যে ১৭ বছর বা তার কম বয়সী শিশু ও কিশোরদের কমে যাওয়ার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
একই সময়ে অন্যান্য গোষ্ঠী বিশেষ করে হিস্পানিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমেরিকার জনসমষ্টি ক্রমে অধিকতর বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠছে। ধনী ও সমৃদ্ধিশালী এ দেশে ভাগ্যের পরিবর্তনে বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষের আগমন বাড়ছে। যতই দামি ও আকর্ষণীয় হোক না কেন, ভৌত প্রতিবন্ধক তৈরি করে এ সুযোগ বন্ধ করা অনেকটা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া পারস্পরিক স্বার্থে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ও সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করাও সমীচীন হবে না।
লন্ডনেও অর্থনীতিতে জনসমষ্টির বৈশিষ্ট্যের প্রভাব রয়েছে। বিভিন্ন পশ্চাৎপটের মানুষের নতুন উদ্যোগ ও প্রবর্তনে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক আগেই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী শহরগুলোর মধ্যে লন্ডন অন্যতম হয়ে ওঠে। তথ্যপ্রযুক্তি, আর্থিক ও পেশাগত সেবা খাতগুলোর অব্যাহত উন্নতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। অধিকতর দক্ষ কর্মজীবীদের আকর্ষণ করতে সুনির্দিষ্ট নীতি গ্রহণে গুরুত্ব দেয়া হয়। উদ্ভাবনী কর্মজীবীদের দক্ষতা ও উদ্যোক্তাবাদ স্পৃহা নিয়ে লন্ডন নগরের পুনরুত্থান হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বহুমাত্রিক নগর হিসেবে গড়ে উঠতে থাকে। বর্তমানে বহু কৃষ্টির জনসমষ্টির নগর হিসেবে লন্ডনের অবস্থান যতদূর সম্ভব সবচেয়ে উপরে। রোমান সাম্রাজ্য আমলে লন্ডন বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল।
গত ২০০ বছরে এ নগরে অব্যাহত অভিপ্রয়াণে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের অনেকেরই জন্ম অভিবাসী পরিবারে। লন্ডনের বর্তমান মেয়রের মা-বাবা গত শতাব্দীর ষাটের দশকে পাকিস্তান থেকে ব্রিটেনে যান। সিঙ্গাপুরের রফতানিমুখী অর্থনীতির অন্যতম পুঁজি হলো বিদেশী মানবসম্পদ। চলতি দশকের শুরুতে এ দেশে প্রবাসী সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের উপরে। এদের এক-চতুর্থাংশের বেশি স্থায়ী অধিবাসী। সিঙ্গাপুরের বাইরে জন্মগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল এক-পঞ্চমাংশের উপরে। বিদেশী দক্ষ ও পেশাজীবীরা তাদের পরিজনদের নিয়ে এসে স্থায়ী আবাস এবং পর্যায়ক্রমে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারে।
মালয়েশিয়ার অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে কাঁচামাল আহরণ শিল্প নির্ভরশীল থেকে হালকা ম্যানুফ্যাকচারিং এবং পরবর্তী সময়ে রফতানি ও সেবার লক্ষ্যে অধিক দক্ষতাশীল ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে পরিবর্তন হয়েছে।
এ পরিবর্তনে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ, শিল্প স্টেট বা মুক্ত বাণিজ্য গঠন এবং পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের উন্নতির সঙ্গে পরিবহন সুবিধা বৃদ্ধি সহায়ক হয়েছে। এতে মালয়, চীন ও ইন্ডিয়ান জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত জনসমষ্টি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে আসছে।
দেশের অধিবাসীরাও অনেক আগে থেকেই বহুকৃষ্টির সমাজে বসবাস করে আসছে। নিজ জাতিগোষ্ঠী, কৃষ্টি ও ধর্ম নিয়ে একতাবদ্ধ হয়ে এবং আন্তঃসাংস্কৃতিক সম্পর্ক বজায় রেখে জীবনযাপন করছে।
দেশের অগ্রগতি ও অব্যাহত উন্নয়নে এ সম্পৃক্তি একান্তই প্রয়োজনীয়। বঞ্চনার কারণে জনগোষ্ঠীর কোনো অংশে উদ্ভূত অসন্তোষ উন্নয়নে ব্যাঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ঔপনিবেশিক শাসন আমলের উন্নয়ন ধারা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। বহুকৃষ্টিভিত্তিক দক্ষ ও মেধাবী জনসমষ্টি গঠন ও সর্বজনীন জাতীয় পরিচয় অর্থনৈতিক সফলতা ও স্থিতিশীল উন্নয়নে অবদান রাখে।