কথা রাখলেন না ব্যাংক মালিকেরা
আবুল বাশার
ব্যাংক মালিকেরা কথা রাখলেন না। সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন অনেক, কথাও দিয়েছিলেন সুদের হার কমাবেন বলে। কিন্তু কমল তো নাই, বরং বেড়েছে। কেন বাড়ল এই প্রশ্ন ছিল সবার। ঘএকটি বৈঠকের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। ব্যাংক খাত নিয়ে দুটি বৈঠক হয়েছিল গত বছরের ২০ জুন। অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ব্যাংক মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় এ ঘটনা আর কখনো কেউ শুনেছেন বলে মনে হয় না। তাও আবার বাংলাদেশ ব্যাংককে পাশ কাটিয়ে। বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল ব্যাংকঋণের সুদহার ‘সিঙ্গেল ডিজিট’ বা ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা। প্রথম বৈঠকটি হয়েছিল সচিবালয়ে, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে। এর পরের বৈঠকটি হয় বেসরকারি ব্যাংকের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের সভাপতিত্বে, গুলশানে সংগঠনটির কার্যালয়ে। নজরুল ইসলাম মজুমদার এরপরে সাংবাদিকদের কয়েকটি সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন। যেমন, আমানতের বিপরীতে কাউকে ৬ শতাংশের বেশি সুদ ব্যাংকগুলো দেবে না এবং ব্যাংকঋণের সুদহার হবে ১০ শতাংশের কম।
অবশ্য এভাবে বৈঠক করে সুদহার কমানোর জন্য ব্যাংক মালিকেরা এর আগেই সরকারের কাছ থেকে বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নেন। যেমন, ব্যাংক ব্যবসার করপোরেট কর কমানো হয় ২ দশমিক ৫ শতাংশ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নগদ জমার হার (সিআরআর) কমানো হয় ১ শতাংশ, টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকা এবং এক পরিবারের চারজনকে ব্যাংকের পর্ষদে থাকার সুযোগ দিয়ে সংশোধন করা হয় ব্যাংক কোম্পানি আইন। কেবল তাই নয়, ৫০ ভাগ পর্যন্ত সরকারি আমানত গ্রহণের সুযোগও আদায় করে নিয়েছেন বেসরকারি ব্যাংক মালিকেরা।
বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী দুহাত ভরে দিয়েছেন ব্যাংক মালিকদের। এতে মালিকদের আয় বেড়েছে, ভরা পকেটে বাসায় যেতে পেরেছেন। কিন্তু যে প্রতিশ্রæতি দিয়ে এসব সুবিধা নিলেন, সেটি বেমালুম ভুলে বসে আছেন। কেবল তা–ই নয়, বরং পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। ব্যাংকঋণের সুদহার যেখানে ১০ শতাংশের নিচে হওয়ার কথা, সেখানে অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়ে আমানতই নিচ্ছে ১০ শতাংশ পর্যন্ত সুদে। এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতেও ১০ শতাংশ সুদ দিতে হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ঋণের সুদহার অনেক বেশি। কোনো কোনো ব্যাংকের ঋণের সুদহার ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত বলে জানা যাচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এমনটি হলো। আসলে সরকারের সঙ্গে বসে ব্যাংক মালিকেরা যে এক অঙ্কে সুদহার নামানোর কথা বলেছিলেন, তার বাস্তবতাই নেই। এত কম সুদে ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা ব্যাংকগুলোর নেই। বরং আস্থার সংকটে পড়ে ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে, ফলে এসব ঋণ থেকে কোনো আয় নেই। কিন্তু আমানতকারীদের ঠিকই নিয়মিত সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। আবার বড় কয়েকটি গ্রুপ ঠিকই সুদ কমিয়ে নিয়েছে, অনেকে টাকাও পরিশোধ করছে না। ব্যাংকও তাদের ঋণকে খেলাপি করছে না।
এখন আবার নতুন করে ঋণখেলাপিদের নতুন করে সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে আরেক দফা বিপদে পড়তে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো।
এ থেকে একটা শিক্ষা হলো, অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত অর্থনীতির আলোকেই নিতে হয়। নইলে সমস্যা আরও বাড়ে। যেমনটি হয়েছে ব্যাংক খাতে। আর কাজটি ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের। সুতরাং এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যাংক মালিকদের দেওয়া সুযোগ-সুবিধা কি প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে? কিন্তু সরকার সেটি করবে বলে মনে হয় না। তবে সরকারের কাজ প্রশ্ন তোলা নয়, বরং সমাধান করা।