ভল্টা লেক ও দাস শিশুদের জীবন, পিতামাতা যখন আপন সন্তান বিক্রি করেন
আবুল বাশার
সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ভল্টা লেকের জলরাশি শিশুদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠলো। তবে এই কলকাকলি আনন্দের নয়, বিষাদের। শিশুদের মধ্যে একজনের নাম আদম। সে একজন দলনেতাও বটে। আদম ও তার সাথে আরও পাঁচ শিশু লেকের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আর ঘানার মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত ভল্টা লেকের সবুজ ঘাসগুলো তাদের দীর্ঘদিনের দুঃখ গাঁথার সঙ্গী। এই ছয় শিশু ঘানার বিভিন্ন শহর থেকে, বিভিন্ন সময় এখানে এসেছে। কিন্তু একটি বিষয়ে তাদের সবার মিল রয়েছে। আর তা হলো, তারা সকলেই এক মুনিবের অধীনে কর্মরত। এমন আরও অনেক শিশু এই লেকের বুকে বেড়ে উঠছে। সারাদিন মাছ ধরা তাদের কাজ। দু’বেলা খাবারের বাইরে তাদের কোনো পারিশ্রমিক নেই। অর্থাৎ তারা সকলে ‘শিশু ক্রিতদাস’। এদের মধ্যে একজন ১২/১৩ বছরের দলনেতা আদম।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে, এই ভল্টা লেকে আদমের মতো আরও প্রায় ২০,০০০ শিশু মাছ আহরণের কাজে নিয়োজিত আছে এবং তারা সকলে কোনো না কোনো মনিবের অধীনে দাসত্বের জীবন অতিবাহিত করছে। অধিকাংশ শিশু কয়েকশ মাইল দূর থেকে পাচারের শিকার হয়ে এখানে এসেছেন। যাদের জন্ম অত্যন্ত গরীব পরিবারে। স্বল্প কিছু টাকার লোভে পিতা-মাতা তার সন্তানকে পাচারকারীদের হাতে তুলে দেন। পাচারকারীরা গড়ে ২৫০ ডলারে এসব শিশুদের ক্রয় করে; যা এসব অঞ্চলের একটি গাভীর দামের সমান।
এই সংবাদ পেয়ে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আদম ও তার পাঁচ সহযোগীর দৈনন্দিন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য তাদের পিছু নেয়। এতে দেখা যায়, সকাল হওয়ার আগেই তাদের কাজ শুরু হয়। কাঠের তৈরি একটি নৌকায় করে তারা মাছ ধরতে যায়। একজন যুবক নাবিকের ভূমিকা পালন করে। সে নৌকার ইঞ্জিনে স্টার্ট দেয়; পানিতে দুলতে দুলতে ক্রমান্বয়ে নৌকাটি লেকের নির্দিষ্ট স্থানের দিকে এগিয়ে যায়।
তারপর আদমদের মাছ ধরার কার্যক্রম শুরু হয়। ইতোমধ্যে বেশ ভালো পরিমাণে মাছ তারা ধরতে সক্ষম হয়েছে। তখন আনুমানিক সকাল ৯টার মতো বাজে। মনিব স্যামুয়েল হঠাৎ বীভৎস চীৎকার দিয়ে উঠলেন। সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়লো। আদম মাথা অবনত করে মুনিবের সামনে দন্ডায়মান হলো। মুহূর্তের মধ্যে মুনিব আদমের শার্টের কলার ধরে আকাশের দিকে উঁচু করে ধরে কী সব যেন বললো; মারাত্মক কোনো অভিযোগের কথা। তারপর কিছু অকথ্য গালাগালি; এরপর ভুলের মাশুল হিসেবে ভল্টা লেকের ঘোলা পানিতে আছড়ে ফেলা হলো আদমকে। এখানেই শেষ নয়, আদম যখন অসহায় ভৃত্যের মত সাঁতরে নৌকার কাছে আসলো, স্যামুয়েল তাকে পানির মধ্যে জালের জট ছাড়ানোর নির্দেশ দিলেন। এমন দৃশ্য দেখার পর পর্যবেক্ষণের কিছু আর বাকী থাকে না। সুযোগ বুঝে জানতে চাইলে আদম বলে মুনিব যখন আপনাকে ডুব দিতে বলবে, তখন আপনার আর বিকল্প কোনো উপায় থাকবে না। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো, তাহলে আর জীবন নিয়ে ফিরে আসা যাবে না। এখানে ভয় সবসময় আপনার জুজুর মতো ভয় কাজ করতে থাকবে। যখন এখানে একবার আটকা পড়বেন, তখন আর ফেরার কোনো উপায় থাকবে না। এজন্যই আমার এত ভয়; এত শঙ্কা। আমি এই লেকে আর এক মুহূর্তের জন্যও কাজ করতে চাই না।
ভল্টা লেকে আদমের মতো শিশুদের এভাবে ডুব দিয়ে জাল ছাড়ানো কিংবা ডুব দিয়ে মাছ তুলে আনা এমনিতেই ভয়ঙ্কর কাজ; কেননা লেকের তলদেশে রয়েছে মৃত গাছের এলোমেলো ধারালো মূল।
এর পাশাপাশি তাদের ওপর শারিরিক মানসিক নির্যাতন তো রয়েছেই। ভল্টা লেকের মুনিবগণ শ্রমিক হিসেবে শিশু দাসদের বেছে নেওয়ার পেছনে এই ধারালো গাছের মূলও একটি কারণ। কেননা মাঝে-মধ্যেই এই গাছের মূলে জাল পেঁচিয়ে যায়, যা শিশুদের ছোট হাত ও আঙ্গুলের সাহায্যে ছাড়িয়ে আনা তুলনামূলকভাবে সহজ। তাছাড়া বয়স্করা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব কাজ করতে রাজিও হন না। তবে এটিই একমাত্র কারণ নয়। শিশুদের জেলে হিসেবে নেওয়ার পেছনে আরো অনেক কারণ রয়েছে। শিশুদের দেহের আকার বড়দের চেয়ে অনেক কম। ফলে তাদের থাকার জন্য স্বল্প জায়গার দরকার হয়; নৌকাতেও তাদের জন্য কম জায়গা লাগে। পাশাপাশি মুনিবরা শিশু দাসদের সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। সর্বোপরি, এদের বিনা পারিশ্রমিকে খাটিয়ে নেওয়া যায়।
প্যাকোডিপ ঘানা ভিত্তিক একটি অলাভজনক সংস্থা। এই সংস্থাটি শিশুদের এমন অমানবিক দাসত্বের জীবন থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে। সংস্থার সদস্যরা লেকে গিয়ে শিশুদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। তারা তাদের মুনিবদের সাথে কথা বলছেন এবং শিশুদের মুক্ত করে আনছেন। তারপর শিশুদের নিরাপত্তা প্রদান করছেন এবং স্কুলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। তারা এই পদক্ষেপের নাম দিয়েছেন ‘ভিলেজ অফ লাইফ’। তারা এ পর্যন্ত প্রায় ১০০টি শিশুকে এই অন্ধকারাচ্ছন্ন দাসত্বের জীবন থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন।
তবুও আনন্দের সংবাদ এই যে, আদম ও তার ৫ সহযোগীকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে প্যাকোডিপ নামের সংস্থাটি।
তাদের মুনিব স্যামুয়েলকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আপোষের মাধ্যমে তাদেরকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। আপোষ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এজন্য স্যামুয়েলকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে। কেননা স্যামুয়েলও এসব শিশুদের অর্থের বিনিময়ে তাদের পিতা-মাতার থেকে ক্রয় করেছিলেন।
অবশেষে আদমসহ ছয় শিশু তাদের গ্রামে ফিরে এসেছে। মানুষ জড়ো হয়েছে তাদের দেখার জন্য; কেননা সাধারণত কোনো শিশু এমন অকস্মাৎ ফিরে আসে না। আদমরা কীভাবে ফিরে এলো, সেই গুঞ্জন সবার মধ্যে। আদমদের ফিরে আসাটা এতটাই অদ্ভুত ব্যাপার তাদের কাছে!