তুচ্ছ সম্পদের মোহে আচ্ছন্ন মানুষ
ড. মুহাম্মদ এনামূল হক আজাদ
বর্তমান বিশ্বের মানুষ উর্ধ্বশ্বাসে সম্পদের পিঁছে দৌড়াচ্ছে। যেন সম্পদ অর্জনটাই মানুষের একমাত্র কাজ এবং এর জন্যেই তার অস্তিত্ব ও তার জীবন। এ সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে তারা ন্যায়-অন্যায়, হালাল-হারাম, নৈতিক-অনৈতিক কোন কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। সমগ্র বিশ্বের সকল মানুষের সব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে শুধুমাত্র এ লক্ষ্যেই। আজকের পৃথিবীর সকল দেশের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাও পরিচালিত হচ্ছে শুধুমাত্র এ লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে। শিক্ষার্থীদেরকে গড়ে তোলা হচ্ছে শুধুমাত্র অর্থ-সম্পদ অর্জনের যোগ্য মেশিন হিসেবে। শুধু এ জন্যেই উন্মোচিত হচ্ছে শিক্ষার নতুন নতুন দিগন্ত। কর্মের নতুন নতুন ক্ষেত্র। কেউ নিজেকে বা সন্তানকে যোগ্য অর্থ-সম্পদ অর্জনকারী হিসেবে দেখতে পেলে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে যে, আমার জীবন স্বার্থক, আমি সফল, আমার সব কাজ সমাপ্ত, আমার দায়িত্ব পালন পরিপূর্ণ।
প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক বলেন, ‘প্রাচুর্যের লালসা তোমাদের গাফেল রাখে। এমনকি তোমরা কবরে পৌঁছে যাও। এটা কখনও উচিত নয়। তোমরা সত্বরই জেনে নেবে।’ সুরা তাকাসুর:১-৩
আল্লাহপাক আরো বলেন, ‘যে অর্থ সঞ্ছিত করে ও গণনা করে, সে মনে করে যে, তার অর্থ চিরকাল তার সাথে থাকবে। কখনও না, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে পি’কারীর মধ্যে। আপনি কি জানেন, পি’কারী কী? এটা আল্লাহর প্রজ্জলিত আগুন। যা হৃদয় পর্যন্ত পৌঁঁছবে। এতে তাদের বেঁধে দেয়া হবে লম্বা খুঁটিতে।’ সুরা হুমাযা:১-৯
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে শিখখীর রা. বলেন, আমি একদিন রাসূল্ল্লুাহ সা.-এর কাছে পৌঁছে দেখলাম তিনি সূরা তাকাসূর তিলাওয়াত করে বলছিলেন, ‘মানুষ বলে আমার ধন, আমার ধন, অথচ তোমার অংশ তো ততটুকু যতটুকু তুমি খেয়ে ফেল অথবা পরিধান করে ছিন্ন করে দাও অথবা সদকা করে সম্মূখে পাঠিয়ে দাও। এ ছাড়া যা আছে তা তোমার হাত থেকে চলে যাবে তুমি অপরের জন্যে তা ছেড়ে যাবে। -ইবনে কাসির, তিরমিজি, আহমদ, মাআরেফুল কুরআন
এই যে সম্পদ, যার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে মানুষ তার সমগ্র জীবনকে ব্যয় ও বিনাশ করছে, দ্বিদ্বাহীন চিত্তে ও নির্ভয়ে এগিয়ে যাচ্ছে জাহান্নামের দরজার দিকে, কি তার মূল্য? কতটুকু তার সত্যিকার মূল্যমান? এ প্রসঙ্গে পবিত্র কালামে পাকে একটি সুন্দর বর্ণনা রয়েছে। মহান আল্লাহ পাক বলেন, ‘যদি সব মানুষের এক মতাবলম্বী হয়ে যাবার আশংকা না থাকতো, তবে যারা দয়াময় আল্লাহকে অস্বীকার করে আমি তাদের দিতাম তাদের ঘরের জন্যে রৌপ্য নির্মিত ছাদ ও সিঁড়ি, যার উপর তারা চড়ত এবং তাদের ঘরের জন্যে দরজা দিতাম এবং পালঙ্ক দিতাম, যাতে তারা হেলান দিয়ে বসত এবং স্বর্ণ নির্মিতও দিতাম। এগুলো সবই তো পার্থিব জীবনের ভোগ সামগ্রী মাত্র। আর পরকাল আপনার পালনকর্তার কাছে তাদের জন্যেই যারা ভয় করে।’ সুরা যুখরুফ:৩৩-৩৫
এ বাণী থেকে বুঝা যাচ্ছে, দুনিয়ার ধন-দৌলত আল্লাহর কাছে এত নিকৃষ্ট ও তুচ্ছ যে, সব মানুষের কাফের হয়ে যাবার আশঙ্কা না থাকলে তিনি সব কাফেরের উপর স্বর্ণ-রৌপ্যের বৃষ্টি বর্ষণ করতেন। মূল্যহীন সম্পদ, পরিত্যক্ত বস্তু বা উচ্ছিষ্ট খাদ্য-সামগ্রী চোরে নিল না ডাকাত নিল, কুকুরে খেল না বিড়াল খেল, না পিঁপড়া খেল-এতে যেমন আমাদের কোন কিছু যায় আসে না। আমরা এ ব্যপারে তেমন কোন চিন্তা-আপসোস করি না। আল্লাহ পাকের কাছেও সমগ্র পার্থিব সম্পদ অনুরূপ মূল্যহীন, পরিত্যক্ত ও উচ্ছিষ্ট। এটি মুসলিম খেল না কাফের খেল এতে তাঁর কিছু যায় আসে না। উপরন্তু পরকালীন মূল্যবান সম্পদে যেহেতু কাফেরদের কোন অংশ নেই, তাই এ মূল্যহীন উচ্ছিষ্ট পার্থিব সম্পদের কিছু অংশ তাদের কিছু দিন ভোগ করতে দিতে আল্লাহপাকের কোন অনিহা নেই। কিন্তু বাঁধ সেঁধেছে মু’মিনদের ঈমানের দুর্বলতা। পৃথিবীতে বসবাসকারী কিছু অবিশ্বাসীর জীবনে কিছু ধন-সম্পদ, প্রভাব প্রতিপত্তি, কোন কোন ক্ষেত্রে কিছু প্রাচুর্যের স্পর্শ লাগলেও এখনো তা আল্লাহ পাকের ঘোষিত স্বর্ণ-রৌপ্য বর্ষণের প্রচুর্যের দূরতম নিকটেও যায়নি। এতেই আমরা বিশ্বাসীরা যেন খেই হারিয়ে ফেলেছি। উর্ধ্বশ্বাসে-চোখ বন্ধ করে তাদের অনুকরণে-অনুসরণে প্রাচুর্য লাভের জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। আগ-পাছ চিন্তা করার সময় নেই। সময় নেই ভাববার ভাল-মন্দ, লাভ-অলাভ, কল্যাণ-অকল্যাণের। ধরেই নিয়েছি প্রাচুর্য মানেই উন্নতি, সম্পদের আধিক্য মানেই কল্যাণ। অথচ হযরত উকবা ইবনে আমের রা. নবী করীম সা. হতে বর্ণনা করেন, তিনি ইরশাদ করেন, ‘যখন তোমরা দেখতে পাবে যে, আল্লাহ তা‘আলা কোন ব্যক্তিকে তার অসংখ্য পাপ ও নাফরমানি সত্ত্বেও তার বাসনা অনুযায়ী দুনিয়ার অফুরন্ত নিয়ামত দান করিতেছেন, তখন মনে করবে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে ইস্তেদরাজ বা সুযোগদান ছাড়া আর কিছু না।’
আল্লাহ পাক বলেন, ‘মানবকুলকে মোহাগ্রস্থ করেছে নারী, সন্তান-সন্তুতি, রাশিকৃত স্বর্ণ-রৌপ্য, নিশান লাগানো অশ্ব, গবাদি পশুরাজি এবং ক্ষেত-খামারের মত আকর্ষণীয় বস্তুসামগ্রী। এ সবই হচ্ছে পার্থিব জীবনের ভোগ্য বস্তু। আল্লাহর কাছে হলো উত্তম আশ্রয়। বলুন, আমি কি তোমাদের এ সবের চাইতেও উত্তম বিষয়ের সন্ধান বলবো? যারা পরহেযগার আল্লাহ তা‘আলার কাছে তাদের জন্যে রয়েছে বেহেশ্ত, যার তল দেশে প্রস্রবণ প্রবাহিত-তারা সেখানে থাকবে অনন্তকাল। আর রয়েছে পরিচ্ছন্ন সঙ্গিনিগণ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি সুদৃষ্টি রাখেন।’ সুরা আল ইমরান:১৪-১৫
এখন আমাদের চিন্তা করা দরকার, আমরা কি বুদ্ধিমান থাকবো না দুর্বল-সাহসহীন হবো? মহামূল্যবান সম্পদের অধিকারী হবো না মূল্যহীন সম্পদের অধিকারী হবো? ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার মূল্যহীন সম্পদের লোভে মোহাচ্ছন্ন থাকবো না চিরস্থায়ী মহামূল্যবান উত্তম সম্পদের আকাক্সক্ষী হয়ে সজাগ হবো? মহানবি সা. এর নিম্নোক্ত হাদিসে এর উত্তর ও উত্তম সমাধান রয়েছে। আল্লাহপাক আমাদের তা গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াকে নিজের প্রিয়তম ও লক্ষ্যবস্তু রুপে গ্রহণ করবে, সে তার পরকালের বিশেষ ক্ষতি সাধন করবে। আর যে পরকালকে অধিকতর প্রিয় রুপে গ্রহণ করবে, সে অবশ্যই তার দুনিয়ার দিকের বড়ই ক্ষতি সাধন করবে। অতএব নশ্বর জগতের মুকাবিলায় স্থায়ী ও অক্ষয় পরকালকেই গ্রহণ কর।’ মুসনাদে আহমদ, বায়হাকি
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ