ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ আতঙ্কে উপকূলের ২০ লক্ষাধিক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে
জিয়ারুল হক : বর্তমানে বাংলাদেশের মোংলা বন্দর থেকে ২৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে বুলবুল। রাত ৮টা থেকে মধ্যরাতের মধ্যে যেকোনও সময় এটি তীরে আঘাত হানবে বলবে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। বাংলা ট্রিবিউন,বাংলানিউজ,বার্তা২৪
এর তীরের দিকে এগিয়ে আসার গতিবেগ ঘণ্টায় ১৫ কিলোমিটার এবং বাতাসের গতিবেগ ৮৫ থেকে ১০০ কিলোমিটার। মধ্যরাত নাগাদ এটি বাংলাদেশ সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় আঘাত হানবে। দুই দেশের সুন্দরবন সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে এটি ধীরে ধীরে দুর্বল হবে।
বর্তমানে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়ে বুলবুল আরও উত্তর দিকে অগ্রসর হয়েছে। এর প্রভাবে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরসহ ৯ উপকূলীয় জেলায় ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখানো হচ্ছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এই সতর্কতা জারি থাকবে। ১০ নম্বর সতর্কতার আওতায় থাকা জেলাগুলো হচ্ছে ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো।
৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় থাকা জেলাগুলো হলো চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল মোকাবেলায় সম্ভাব্য সব ধরনের জনসম্পৃক্ততামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে উপকূলীয় সব জেলার পুলিশ ইউনিটগুলোকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
শনিবার এ নির্দেশনার কথা জানান পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা।
তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড় বুলবুল মোকাবেলায় উপকূলীয় সব জেলার পুলিশ ইউনিটগুলোকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী মাঠ পর্যায়ের ইউনিটগুলো সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বহুমুখী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
সরকার প্রদত্ত ত্রাণের সুষ্ঠু বণ্টনের জন্য সব রকমের সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড় চলাকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুলিশের জেলা ও থানা পর্যায়ের ইউনিটগুলোতে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। সেখান থেকে সার্বক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি নজরদারি করে মাঠে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে সমন্বর এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হচ্ছে।
জরুরি প্রয়োজনে দ্রুত সাড়ার জন্য প্রতিটি পুলিশ লাইন্সে প্রয়োজনীয় সংখ্যক রিজার্ভ ফোর্স রাখা হয়েছে বলেও জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
এছাড়া, ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে সব ধরনের উদ্ধারকাজ দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে পুলিশের পক্ষ থেকে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের মজুদ নিশ্চিত করছে।
যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে পুলিশ সদর দপ্তরের কন্ট্রোল রুমে ০১৭৬৯৬৯০০৩৩, ০১৭৬৯৬৯০০৩৪ নম্বরে এবং জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এ যোগাযোগ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
এদিকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’-এর প্রভাবে মোংলা সমুদ্র বন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারির পরও বাগেরহাট ও বরগুনার উপকূলীয় উপজেলাগুলোর মানুষকে দুপুর পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে আগ্রহ দেখায়নি। তবে শনিবার বিকাল থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে যান তারা।
রামপাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তুষার কান্তি পালের বরাত দিয়ে বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, শনিবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত সাড়ে ১২ হাজার লোক আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এই সংখ্যা বাড়ছে।
শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরদার মোস্তফা শাহিন জানান, শরণখোলার চারটি ইউনিয়নে এখন পর্যন্ত ৩০ হাজার লোক আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে।
মোংলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাহাত মান্নান জানান, উপজেলাবাসীকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে আড়াই হাজার স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। ইতিমধ্যে ১০ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে। এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।
মোরেলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান জানান, ২৬ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে।
চিতলমারী উপেজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মারুফুল আলম জানান, লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া যাচ্ছে না। বিকাল পর্যন্ত দেড় শতাধিক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে।
এদিকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারির পর জেলা সদরসহ উপকূলে নতুন করে মাইকিং করা হয়েছে। বিকালে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভা হয়েছে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে।
বন্দরের হারবার মাস্টার কমান্ডার শেখ ফকর উদ্দিন জানান, মোংলা বন্দরে অবস্থান করা দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে পশুর চ্যানেলে নিরাপদে সরিয়ে আনা হয়েছে। এছাড়া বন্ধ রাখা হয়েছে মোংলা বন্দরে জাহাজ আগমন ও নির্গমনও।
বরগুনা প্রতিনিধি জানান, প্রথম দিকে কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে না গেলেও বিকাল থেকে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ছুটছে প্রান্তিক উপকূলের মানুষ। এদিকে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, সিপিপি, রেডক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে আসার জন্য প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
সদর উপজেলার নলী এলাকার সাহিদা নামের এক গৃহবধূ জানান, ‘ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানবে শুনেছি। মাইকিংও করা হয়েছে কিন্তু সাইক্লোন শেল্টারে যে যাবো, সেই অবস্থা নেই। সাইক্লোন শেল্টারগুলোতে নারী ও শিশুদের জন্য কোনও সুব্যবস্থাই রাখা নেই।’
প্রতিটি উপজেলার পাঁচটি করে মেডিক্যাল টিম ও দুটি করে অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রয়েছে।
নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, জেলা প্রশাসন সব ধরনের পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। চট্টগ্রামে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেওয়ার পর উপকূলীয় উপজেলা হাতিয়া, সুবর্ণচর ও কোম্পানীগঞ্জের লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়ার জন্য রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবক দলকে সতর্ক রাখা হয়েছে এবং বিভিন্ন স্থানে জনগণকে নিরাপদে আশ্রয়ে নেয়ার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে। দুপুর ২টার পর থেকে হাতিয়ার আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে লোকজন আসতে শুরু করেছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে পানি ও শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এদিকে তিনটি উপজেলার ৬২৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক ওষুধসহ ১১ টি মেডিক্যাল টিম ও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
ফেনী প্রতিনিধি জানান, উপকূলীয় সোনাগাজী উপজেলায় দুর্যোগকালীন উদ্ধার তৎপরতাসহ বিভিন্ন কাজের জন্য সিপিপির দেড়হাজার স্বেচ্ছাসেবকসহ দুই হাজার কর্মী প্রস্তুত রয়েছেন। মজুদ রাখা হয়েছে শুকনো খাবার। এছাড়াও পরিস্থিতি মোকাবিলায় অর্ধশত আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অজিত দেব বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় ও দুর্যোগ মোকাবিলায় এবং জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনাসহ জনগণকে সর্তক করার লক্ষ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। অর্ধশত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রসহ উপজেলার সব বিদ্যালয়কে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। একটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে এবং ১০টি চিকিৎসক দল, ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে।’
ঝালকাঠি প্রতিনিধি জানান, দুই দিন ধরে বৃষ্টি থাকলেও আশ্রয়ণ কেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ নেই মানুষের মধ্যে। তবে নদীর তীরবর্তী কিছু মানুষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের দিকে ছুটছেন। নলছিটি উপজেলার সুগন্ধা নদীর নিকটবতী ভৈরবপাশা ও মড়গ এবং রাজাপুর উপজেলার বিশখালি নদীর পাড়ের বড়ইয়া ও মঠবাড়ি ইউনিয়নের কয়েকটি আশ্রয়ণ কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন অনেক মানুষ।
জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী বলেন, ‘জেলায় ৭৪টি সাইক্লোন সেন্টার, স্কুল-কলেজ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জেলা পর্যায়ের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। আশ্রয়ণ কেন্দ্রের জন্য ৭ লাখ টাকা, ১১২ মেট্রিক টন চাল ও ২ হাজার মেট্রিক টন শুকনো খাবার প্রস্তুত রাখা হয়েছে।’
পিরোজপুর প্রতিনিধি জানান, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার বেতমোর রাজপাড়া ইউনিয়নের মাঝের চরের লোকজনকে বলেশ্বর নদীর এপারে সরিয়ে আনা হয়েছে। বেতমোর রাজপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, মাঝের চরে চারশ পরিবার বসবাস করে। তাদের অধিকাংশকেই সরিয়ে আনা হয়েছে। সম্পাদনা : রেজাউল আহসান