আদালতে নির্বাক সু চি, নির্বিচার হত্যাকান্ড বন্ধ চায় গাম্বিয়া
অর্থনীতি ডেস্ক : রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) শুনানি শুরু হয়েছে মঙ্গলবার। হেগের আদালতে এ মামলার শুনানি চলবে আগামী ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সমর্থনে গাম্বিয়া আইসিজেতে ওই মামলাটি করেছে। রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দেয়া এবং রাখাইনে গণহত্যার আলামত নষ্টের বিভিন্ন উপাদান উল্লেখ করে গাম্বিয়ার করা অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের নির্দেশনার বিষয়ে তিন দিনের এই শুনানি হচ্ছে। প্রথম আলো অনলাইন, বিডিনিউজ, বার্তা ২৪, ইউএনবি
মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টার দিকে দ্য হেগে বিভিন্ন দেশের ক‚টনীতিক, রোহিঙ্গা এবং মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে শুনানি শুরু হয়। গতকাল গাম্বিয়া তার বক্তব্য উপস্থাপন করে এবং আজ মিয়ানমার তার অবস্থান তুলে ধরবে। আগামীকাল সকালে গাম্বিয়া এবং বিকেলে মিয়ানমার প্রতিপক্ষের যুক্তি খÐন ও চ‚ড়ান্ত বক্তব্য পেশ করবে। মামলার রায় পেতে স্বল্পতম আট সপ্তাহ থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত লাগতে পারে।
গাম্বিয়ার প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সে দেশের আইন ও বিচারমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু। মিয়ানমারের নেতৃত্বে থাকছেন দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি। শুনানির শুরুতে আইসিজের প্রেসিডেন্ট আবদুলকোয়াই আহমেদ ইউসুফ শুনানির প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিচার কক্ষে উপস্থিত সুধীজনদের অবহিত করেন।
দ্য হেগে রোহিঙ্গা গণহত্যার এ বিচারপ্রক্রিয়ায় দেশের হয়ে আইনি লড়াই চালাতে আদালতে উপস্থিত রয়েছেন মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চি। গাম্বিয়ার প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশটির আইন ও বিচারমন্ত্রী আবুবকর মারি তামাবাদু। গাম্বিয়ার প্রস্তাবিত পক্ষে নাভি পিল্লাই এবং মিয়ানমারের ক্লাউস ক্রেসকে এডহক বিচারপতি হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এডহক বিচারপতিদের শপথের মধ্য দিয়ে শুনানির প্রক্রিয়া শুরু হয়।
আইসিজে দায়েরকৃত মামলার শুনানির শুরুতে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্বোধ হত্যাকাÐ বন্ধে দেশটির প্রতি আহŸান জানিয়েছেন গাম্বিয়ার আইন ও বিচারমন্ত্রী।
প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনি মিয়ানমারকে এই নির্বোধ হত্যাকাÐ বন্ধ করতে বলুন। বর্বর এবং নৃশংস এসব কাজ; যা আমাদের সবার বিবেককে আঘাত করেছে। এটি এখনও অব্যাহত রয়েছে।
তিনি বলেন, বিশ্বে যেকোনো স্থানে এমন গণহত্যা হলে দূরে থাকলেও এর বিচারের দায় আমরা এড়াতে পারি না। গণহত্যার কনভেনশনের অধীনে মিয়ানমার তার দায়বদ্ধতা লঙ্ঘন; চলমান গণহত্যা বন্ধ করতে হবে এবং এর দায়বদ্ধতাগুলোর প্রতি সম্পূর্ণ সম্মান জানাতে হবে। রোহিঙ্গারাও মানুষ। তাদের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানসহ বাঁচার অধিকার রয়েছে। রোহিঙ্গা শিশুরও অধিকার রয়েছে শিক্ষা লাভ করে ডাক্তার হওয়ার।
তামবাদু বলেন, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনসহ এবং তাদের পুরো নাগরিকত্ব এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান এবং বৈষম্য, নিপীড়ন এবং অন্যান্য সম্পর্কিত কর্মের বিরুদ্ধে সুরক্ষাসহ গণহত্যা কনভেনশন লঙ্ঘনের পুনরাবৃত্তি না করার নিশ্চয়তা দেয়ারও অনুরোধ জানিয়েছে গাম্বিয়া।
এমসয় পাসিপান্দো বলেছেন, রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণের কথা অস্বীকার করতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি বলেছেন, সেনাবাহিনী এবং বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর কেউ নোংরা বাঙালি মেয়েকে ছোঁবে না। ওরা আকর্ষণীয় নয়। এই আইনজীবী বলেন, ফেসবুকে ‘ফেক রেপ’ নামে যে পেজ খোলা হয়েছে সেটির নিয়ন্ত্রণও হচ্ছে স্টেট কাউন্সিলরের দপ্তর থেকে।
পাসিপান্দো এরপর আদালতের কাছে আরাকানে এখনো যে ৬ লাখ রোহিঙ্গা আছেন তাদের দুর্ভোগ ও ঝুঁকির কথা তুলে ধরেন। পাসিপান্দো বলেন, সেখানে রোহিঙ্গাদের কাঁটাতারের বেষ্টনীর মধ্যে শিবিরে আটক রাখা, চলাচলের স্বাধীনতা খর্ব করা ও অন্যান্য বিধিনিষেধের কথা যা জাতিসংঘ তদন্তে উঠে এসেছে সেগুলোর বিবরণ দেন।
এই আইনজীবী বলেন, রোহিঙ্গাদের চাষাবাদের জমি কেড়ে নেয়া হয়েছে, খাদ্য সরবরাহ কমানো হয়েছে, তাদের পালিত পশু কেড়ে নেয়া হয়েছে বলে জাতিসংঘ তদন্তে যে তথ্য উঠে এসেছে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের অভুক্ত রাখা। এগুলো গণহত্যার উদ্দেশ্য হিসাবে সনদের লঙ্ঘন। আরও গণহত্যার অপরাধ যাতে না ঘটে সে জন্য ব্যবস্থা নিতে পারে এই আদালত।
অধ্যাপক পায়াম আখাভান বলেন, তদন্তে গণহারে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার প্রমাণ মিলেছে যা সনদের লঙ্ঘন। গণহত্যা সনদ ও আইসিসির রায়ে যে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতাকে গণহত্যার মতো অপরাধ গণ্য করা হয়েছে, জাতিসংঘ তদন্তে সে ধরনের অপরাধের বর্ণনা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আইনজীবী অ্যান্ড্রæ লোয়েনস্টেইন যুক্তি তুলে ধরে বলেন, মিয়ানমারের জনমিতিক গঠন (ডেমোক্রাফিক) পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। সেনাপ্রধান রোহিঙ্গাবিরোধী প্রচারে জড়িত থাকায় তার ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে হয়েছিলো, যা রাষ্ট্রীয় নীতি ও ভ‚মিকার প্রমাণ।
এদিকে কৃত অপরাধের জন্য মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও তার সেনা অধিনায়কদের ফৌজদারি বিধিতে জবাবদিহির দাবি জানিয়েছেন শান্তিতে সাত নোবেল বিজয়ী। এক যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেন ‘শান্তিতে নোবেল বিজয়ী হিসেবে আমরা নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণকারী অং সান সু চি-কে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চালানো গণহত্যাসহ সব অপরাধ জনসম্মুখে স্বীকার করার আহŸান জানাই।
নোবেলে বিজয়ীদের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যে অপরাধের নিন্দা না করে বরং অং সান সু চি সক্রিয়ভাবে অস্বীকার করে যাচ্ছে যে এসব অপরাধ এমনকি কখনো ঘটেনি। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করা শান্তিতে সাত নোবেল বিজয়ী হলেনÑইরানের শিরিন এবাদি, লাইবেরিয়ার লেমাহ গবোই, ইয়েমেনের তাওয়াক্কল কারমান, উত্তর আয়ারল্যান্ডের মেরেইড ম্যাগুয়ার, গুয়াতেমালার রিগোবার্টা মেনচা তুম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জোডি উইলিয়ামস এবং ভারতের কৈলাশ সত্যার্থী।
নোবেল বিজয়ীরা বলেন, শান্তিবাদী মানুষ হিসেবে শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সু চি-কে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা, ভ‚মির মালিকানা, চলাফেরার স্বাধীনতা এবং মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের বিষয়ে কাজ করার আহŸান জানাচ্ছি।
আদালত কক্ষে গাম্বিয়ার আইনজীবী দলের সদস্যরা যখন মিয়ানমারের নৃশংসতার চিত্র তুলে ধরেন তখন নির্বিকার দেখা যায় অং সান সু চিকে। এ সময় আদালতের বাইরে কয়েক ডজন রোহিঙ্গাকে ন্যায়বিচারের দাবিতে সমাবেশ করতে দেখা যায়।
ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তিন দিনব্যাপী শুনানি চলাকালে জাতিসংঘের এই সর্বোচ্চ আদালতের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। জানা গেছে, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অংশ হিসেবে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হতে পারে। তবে মিয়ানমার সরকারের প্রধান হিসেবে সু চিকে দায়মুক্তি দেয়া হতে পারে।
তবে প্রাথমিক শুনানিতে নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের কারও বক্তব্য শোনা হবে না। ‘ওয়ার্ল্ড কোর্ট’ বা বিশ্ব আদালত হিসেবে পরিচিত আইসিজেতে গত মাসে মামলা করে গাম্বিয়া। এতে ক‚টনৈতিক ও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে ওআইসি। শুনানি শুরুর আগের দিন গাম্বিয়ার উদ্যোগকে সমর্থন দিয়েছে কানাডা এবং নেদারল্যান্ডস।
এর আগে সোমবার এক যৌথ বিবৃতিতে দেশ দুটি বলেছে, জবাবদিহি নিশ্চিত এবং দায়মুক্তি রোধ করতে তারা গাম্বিয়াকে সর্বতোভাবে সহায়তা করবে। বিবৃতিতে বলা হয়, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর দায়িত্ব ছিলো রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দেয়া। অথচ নিরাপত্তা বাহিনীই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। জানা গেছে, তৎপরতার অংশ হিসেবে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রæডোর মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত বব রে ইতোমধ্যে হেগে পৌঁছেছেন। ফাতেমা আহমেদ। সম্পাদনা : রেজাউল আহসান