করিম হোসেনদের কি আইনি সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার নেই?
রিকশাচালক করিম হোসেন। জীবিকার প্রয়োজনে রোদ-বৃষ্টি-শীত-গরমে রিকশা নিয়ে ছুটতে হয় রাজধানীর গলি থেকে রাজপথে। কারও সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্ব বা শত্রুতা আছে কিনা তিনি নিজেও জানেন না। তবু বুলেটের আঘাতে আহত হতে হয়েছে রিকশাচালক করিম হোসেনকে। হার ভাঙা শ্রমের মজুরি দাবি করলে নিজের রিকশার মাতাল যাত্রীর লাইসেন্স করা অস্ত্রের বুলেটের আঘাতে আহত হন। ওই যাত্রী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন আওয়ামী যুবলীগের বনানী এলাকার এক স্থানীয় নেতা। খুব সম্প্রতি এই ঘটনাটি ঘটে।
ঘটনা ঘটিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই ওই নেতা বনানী থানায় গিয়ে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে নিজের আত্মরক্ষার জন্য লাইসেন্স করা অস্ত্রের গুলি ব্যবহার করেছেন বলে সাধারণ ডায়েরি করতে ভোলেননি। আহত রিকশাচালক সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় চিকিৎসা নিয়ে ফেরার পর নিজেই বাদি হয়ে বনানী থানায় মামলা দায়ের করেন। গণমাধ্যমের তৎপরতার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর কিছুটা টনক নড়ে। এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী শেষ পর্যন্ত তাকে আটক রাখতে পারেনি। কারণ মামলার বাদি রিকশাচালক করিম হোসেনের অনাপত্তিতে ঢাকার হাকিম আদালত সরকার সমর্থক এই সংগঠনটির নেতাকে জামিন দেন। এর আগেও আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার আলম রনির কা-। ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল রাতে নিউ ইস্কাটন রোডে রনি নিজ গাড়ি থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়েন। এতে রিকশাচালক হাকিম ও অটোরিকশাচালক ইয়াকুব আলী আহত হন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৫ এপ্রিল হাকিম এবং ২৩ এপ্রিল ইয়াকুব মারা যান। ২০১৫ সালের ১৫ এপ্রিল রমনা থানায় অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে হাকিমের মা মনোয়ারা বেগম বাদি হয়ে মামলা করেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ২৪ মে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ৩১ মে এলিফ্যান্ট রোডের বাসা থেকে রনিকে আটক করেন। ওই ঘটনায়ও আমরা দেখেছি, রনি মাতাল অবস্থায় নিজের মায়ের সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো গাড়ি ও লাইসেন্স করা অস্ত্র ব্যবহার করেই হত্যা করেন দুজন সাধারণ খেটে খাওয়া নিরীহ মানুষকে। হাকিম ও ইয়াকুব হত্যার মামলা এখন আদালতে বিচারাধীন। জানি না, হাকিম ও ইয়াকুব হত্যার মামলার বিচার কোন দিকে গড়াবে?
সাতক্ষীরার বহুল আলোচিত মহিলা সংসদ সদস্য ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী রিফাত আমিনের ছেলে রাশেদ সারোয়ার রুমন এলাকার এক আতংকের নাম বলেই গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানা যায়। মায়ের ক্ষমতা ও দাপটকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন অপরাধ তিনি করেছেন বলে জানা যাচ্ছে। গত রমজান মাসে সাহেব আলী নামের এক গরু ব্যবসায়ীকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে জখম করার অভিযোগ আসে রুমনের বিরুদ্ধে। তার কিছুদিন আগে তার মায়ের ব্যবহৃত জাতীয় সংসদের স্টিকারযুক্ত গাড়িতে তিন তরুণীকে নিয়ে অস্ত্রসহ শ্যামনগরের একটি রিসোর্টে ধরা পড়ে বেশ কিছুদিন কারাগারেও থেকে এসেছিলেন রুমন। ১১ সেপ্টেম্বর এক আওয়ামী লীগ নেতাসহ চারজনকে মারপিট করে আবার সংবাদ শিরোনাম হয় রুমন। ওই রাতেই রুমন আত্মগোপনে চলে গিয়েছিল। পরে জানা যায়, পালানোর সময় গাড়ি নিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে বেপরোয়া গাড়ি চালানোর জন্য পরিচিত রুমন। তখন শহরের মাগুরার বউ বাজারের বাঁশতলার সোনা চোরাচালানী মিলন পাল নামে একজনের বাগানবাড়িতে ওঠে রুমন। পরদিন ওই বাগানবাড়িতে আড্ডা দেওয়ার সময় গ্রামবাসী বাড়ি ঘিরে মারধর করে রুমনকে। পরে আওয়ামী লীগ নেতারা গিয়ে তাকে জনরোষ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। অবশেষে যুবলীগ নেতা জুলফিকার আলী উজ্জ্বল ও ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম বুলেটের করা দুটি চাঁদাবাজির মামলায় ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ গ্রেফতার করা হয় রুমনকে। জুলফিকার আলী উজ্জ্বল ক্ষমতাসীন দলেরই একটি অঙ্গসংগঠনের নেতা, সে কারণেই হয়তো রুমনকে কয়েকদিন পুলিশ হেফাজতে, সরকারি খানা খেতে হতে পারে।
তবে সবচেয়ে আতংক ও ভয়ের ঘটনা ছিল টাঙ্গাইল-৩ আসনের সাংসদ আমানুর রহমান ওরফে রানার ঘটনা। আমানুর রহমান রানা টাঙ্গাইলের প্রভাবশালী খান পরিবারের জ্যেষ্ঠ কর্তাব্যক্তি। তার ভাই ও সন্তানেরাও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত। এই পরিবারের বিরুদ্ধে বিগত ২৫ বছরে হত্যা মামলাসহ ৫০টি বিভিন্ন মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে আমানুর একাই ৪৬টি মামলায় অভিযুক্ত। সর্বশেষ মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আহমেদ হত্যাকা-ের পর গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তে তার ও তার ভাইদের নাম আসে। রানার ৪৬ মামলার মধ্যে ৪৪টি থেকে অব্যাহতি এবং একটি স্থগিত রাখার ব্যবস্থা করতে পেরেছেন ইতোমধ্যে। তবে আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আহমেদ হত্যাকা-ের মামলা থেকে অনেক চেষ্টার পরও অব্যাহতির ব্যবস্থা করতে পারেননি। যিনি হত্যাসহ ৪৫টি বিভিন্ন ধরনের মামলার বিচার এড়াতে পেরেছেন, তার শক্তি ও ক্ষমতার বিষয়টি সবারই অনুমান করা সম্ভব। তবে এবার ২২ মাস পলাতক থাকার পর ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তাকে খুনের মামলায় কারাগারে যেতে হয়েছে। অবশ্য পলাতক অবস্থায়ও নিজের সংসদ সদস্য পদ রক্ষা করার জন্য অন্তত দুবার জাতীয় সংসদে হাজিরা দিতে আসেন সাংসদ রানা। গত ২০১৫ সালের ২ অক্টোবর গাইবান্ধা-১ আসনের সাংসদ মনজুরুল ইসলাম মাতাল অবস্থায় গুলি ছুড়ে আহত করেন সুন্দরগঞ্জ গোপাল চরণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র শিশু শাহাদাত হোসেনকে। পরে সারাদেশে এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলে সাংসদ মনজুরুল ইসলামকে গ্রেফতার করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী। যদিও ওই ঘটনায় বেশিদিন জেলে থাকতে হয়নি সাংসদ মনজুরুলকে।
দেশে বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ নানা শক্তি নানাভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভার গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভার গ্রহণকারীদের মধ্যে কেউ কেউ ক্ষমতার দাপট ও দলীয় প্রভাব খাটিয়ে খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, দখলবাজিসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত থাকে। কখনও কখনও ওইসব ক্ষমতার অপকব্যবহারকারীদের দাপটের কাছে জিম্মি, অসহায়বোধ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিসহ নিজ দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারাও। প্রশ্ন হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত করিম হোসেনদের কি আইনী সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার নেই? নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তা কি বাস্তবে দৃশ্যমান হয় সবসময়? সাধারণ মানুষ দেখতে চায়, সমাজ বা রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করছে।
লেখক: কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান