বায়ু দূষণ
ইকতেদার আহমেদ
আমাদের বায়ুম-ল যে সকল গ্যাসীয় উপাদান সমন্বয়ে গঠিত তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছেÑ নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন। বায়ুম-লে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের পরিমাণ যথাক্রমে ৭৮.০৯% ও ২০.৯৫%। উভয় গ্যাসের সম্মিলিত পরিমাণ ৯৯% এর অধিক। অবশিষ্ট ১% এর কিছু কম যে সকল গ্যাসীয় উপাদান সমন্বয়ে গঠিত তা হলোÑ আর্গন ০.৯৩% ও কার্বন ডাইঅক্সাইড ০.০৩%। তাছাড়া বায়ুম-লে ১% এর অতি ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে নিয়ন, হিলিয়াম, মিথেন, ক্রিপটন, হাইড্রোজেন, জেনন ও ওজনের উপস্থিতি রয়েছে। বায়ুম-লের নিম্নভাগে অঞ্চলভেদে বিভিন্ন মাত্রার জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি রয়েছে। সাধারণত বৃষ্টিপ্রবণ এলাকায় জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি শতভাগ। যে সকল অঞ্চলে বৃষ্টির পরিমাণ কম সে সব অঞ্চলে তুলনামূলক হারে জলীয় বাষ্পের পরিমাণও কম। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকলে মানুষের শরীর হতে নির্গত পানি, যেটিকে ঘাম বলা হয় তা সহজে শুকায় না। এ কারণে বাতাসের জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে ঘাম না শুকানো মানুষের জন্য অস্বস্তিদায়ক। বায়ুম-লের নিম্নভাগে ধুলোবালির উপস্থিতি বায়ুম-লকে দূষিত করে তোলে। সমুদ্র তীরবর্তী স্থানে প্রবাহিত বায়ু সমুদ্রের জলরাশিকে অতিক্রম করে আসায় তা ধুলোবালিমুক্ত নির্মল থাকে। উঁচু পর্বতবেষ্টিত এলাকা বরফ অথবা বৃক্ষরাজি দ্বারা আবৃত থাকায় সেখানকার বায়ু সমুদ্র তীরবর্তী বায়ুর ন্যায় ধুলাবালিমুক্ত ও নির্মল থাকে। এ সকল কারণে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা ও উঁচু পর্বতবেষ্টিত এলাকা স্বাস্থ্যকর স্থান হিসেবে ভ্রমণপিপাসুদের নিকট প্রিয়।
মানুষসহ পৃথিবীর অপরাপর প্রাণীকূলের জীবনধারণের জন্য অক্সিজেন অপরিহার্য। মানুষ প্রতিনিয়ত তার চতুর্পাশের বায়ুম-ল হতে অক্সিজেন গ্রহণ করছে ও কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করছে। অক্সিজেন ছাড়া একজন মানুষের পক্ষে ৩-৪ মিনিটের অধিক বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। যেকোনো জীবন্ত প্রাণীর জন্য নাইট্রোজেন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এটি প্রাণীর দেহে প্রোটিন গঠনে সহায়তা করে। মানুষের দেহের ত্বক ও চুলের গঠনে নাইট্রোজেনের অনন্য ভূমিকা রয়েছে। আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন আমরা উদ্ভিদ হতে পাই, অপরদিকে উদ্ভিদ মাটির সঙ্গে সংমিশ্রিত ব্যাকটেরিয়া হতে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে। মানুষ প্রতিনিয়ত অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগের কারণে বায়ুম-লে অক্সিজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের যে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটছে তার ভারসাম্য উদ্ভিদের কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ ও অক্সিজেন ত্যাগের মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে রক্ষিত হয়ে চলছে। এ কারণে পৃথিবীর ভূ-ভাগে ন্যূনতম চার ভাগের একভাগ বনাঞ্চল থাকার আবশ্যকতা রয়েছে। পৃথিবীর সম্পদশালী ও জনবসতি কম এমন দেশসমূহ এ হার বজায় রাখতে পারলেও দরিদ্র ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশসমূহের পক্ষে এটি সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর এ কারণেই আমাদের দেশে বনাঞ্চলের পরিমাণ কাক্সিক্ষত পরিমাণের চেয়ে অনেক নিম্নে।
পৃথিবীর যেকোনো দেশের গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চল ও শিল্পাঞ্চল ঘনবসতি ও কোলাহলপূর্ণ হওয়ায় শেষোক্ত অঞ্চলদ্বয়ে বায়ু দূষণ অধিক। এসব অঞ্চলে গাড়িঘোড়া ও কলকারখানা হতে নির্গত ধোঁয়া এবং রান্নাঘর হতে নির্গত ধোঁয়া একদিকে বায়ুম-লের কার্বনের উপস্থিতির বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে, অপরদিকে বায়ুম-লের উষ্ণতা বৃদ্ধি করে চলেছে। উভয় দূষণের কারণে শহরাঞ্চল ও শিল্পাঞ্চলে বসবাসরত জনমানুষ বিশুদ্ধ ও নির্মল বায়ুর প্রভাব হতে বঞ্চিত হচ্ছে।
আমাদের দেশে নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে পাথর ইটের তুলনায় ব্যয়বহুল। পৃথিবীর যে সকল দেশের ভূ-ভাগের উপরের স্তরে পাথর রয়েছে এসব দেশ প্রাকৃতিক উৎস হতে পাথর সংগ্রহ করে নির্মাণ কাজ সমাধা করে থাকে। দেশে প্রাকৃতিক উৎস হতে সংগৃহিত পাথর অপ্রতুল হওয়ায় আমাদের নির্মাণ কাজে ইটের ব্যবহার অধিক হচ্ছে। ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে খনিজ কয়লার ব্যবহার অনুমোদিত হলেও জ্বালানি কাঠের ব্যবহার অনুমোদিত নয়। খনিজ কয়লার মূল্য জ্বালানি কাঠ হতে অধিক হওয়ায় অধিকাংশ ইটভাটা মালিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও প্রশাসনের সহায়তায় ইটভাটায় খনিজ কয়লার পরিবর্তে জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করে অধিক মুনাফা অর্জনের পথ সুগম করছে। আইন অনুযায়ী শহরাঞ্চল ও লোকালয়ের আশেপাশে ইটভাটা স্থাপন অনুমোদিত না হলেও দেশে এমন কোনো ইটভাটা নেই যা লোকলয় হতে অনতিদূরে। ইটভাটায় জ্বালানি কাঠের ব্যবহার বনভূমির দ্রুত হ্রাস ঘটিয়ে যেমন বায়ু দূষণে সহায়ক হিসেবে কাজ করছে অনুরূপ ইটভাটা হতে নির্গত কালো ধোঁয়া বায়ু দূষণকে আরও তীব্রতর করছে। ইটভাটায় ইট, বালি ও সিমেন্ট মিশ্রিত অধিক উচ্চতার চিমনি ব্যবহারের বিধান থাকলেও এ চিমনি নির্মাণ ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে অনেক ইটভাটা মালিক এখনও পুরনো ড্রাম দিয়ে নির্মিত চিমনি ব্যবহার করছে।
দেশে শহরাঞ্চলের গৃহস্থালী বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থা বিজ্ঞানসম্মত পন্থায় গড়ে না উঠায় শহরের যে সকল অঞ্চলে গৃহস্থালী বর্জ্য প্রাথমিকভাবে রাখা হয়, সেগুলোতে বর্জ্যরে পরিমাণ ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত হওয়ায় এবং বর্জ্য উন্মুক্ত অবস্থায় রাখায় যে অসহনীয় দুর্গন্ধ ছড়ায় তা আশেপাশের বায়ুম-লকে দূষিত করে তোলে। এ ধরনের দূষিত বায়ু দ্বারা শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ করা হলে তা যেকোনো মানুষের শারীরিক অস্বস্তির কারণ হয়ে দেখা দেয়। তাছাড়া বর্জ্যসমূহ উন্মুক্ত ট্রাকে দিনের বেলায় পরিবহন করায় রাস্তায় চলাচলকারী জনমানুষের স্বাচ্ছন্দ্যে চলার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটে। বর্জ্য অপসারণ স্থল শহরের সন্নিকটবর্তী হওয়ায় তা আশেপাশে বসবাসরত জনমানুষের স্বাভাবিক জীবনকে ব্যহত করে। পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে কখনও বর্জ্য প্রাথমিক স্থানে উন্মুক্ত রাখা হয় না এবং এগুলো সবসময় ঢাকনাযুক্ত গাড়িতে রাতের শেষ প্রহরে পরিবহন করা হয়। এসব দেশে অপসারণ স্থলও শহর থেকে অনেক দূরে জনবসতিহীন এলাকায় হয়। অধূনা অনেক উন্নত দেশ গৃহস্থালী বর্জ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সার উৎপাদনে ব্যবহার করছে। আমাদের দেশে অনুরূপ ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে তা বায়ু দূষণ রোধে সহায়ক হবে।
বায়ুম-লে ধুলোবালির উপস্থিতি স্বাচ্ছন্দ্যে ও সাবলীলভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণের অন্তরায়। দেশে শহরাঞ্চলে বছরব্যাপী এবং গ্রামাঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে ধুলোবালির ব্যাপক উপদ্রব দেখা দেয়। এ ধরনের ধুলোবালিযুক্ত বায়ু প্রতিনিয়ত আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটিয়ে বিভিন্ন রোগের কারণের উদ্ভব ঘটাচ্ছে।
পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহ বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনমানুষের জন্য সহায়ক ও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে অনবদ্য অবদান রেখে চলেছে। আমরা এ পথে উন্নত দেশের ন্যায় সফলতা না পাওয়ায় দেশের সামগ্রিক বায়ুম-লের পরিবেশ সুস্বাস্থ্যের জন্য এখনও নিরাপদ হয়ে উঠতে পারেনি। আর যতদিন পর্যন্ত এটি নিরাপদ না হবে ততদিন পর্যন্ত বায়ু দূষণ উন্নত ও সমৃদ্ধিশালী এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে অন্তরায় হয়ে থাকবে।
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান