চিরিরবন্দরের তাঁতশিল্প বিলুপ্তির পথে
মো. আব্দুস সালাম, চিরিরবন্দর (দিনাজপুর) : তাঁতশিল্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনা, সুদক্ষ তাঁতশিল্পী, সস্তা শ্রমিক থাকা সত্ত্বেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত ও রপ্তানির সু-ব্যবস্থা না থাকায়, পর্যাপ্ত ও সহজ শর্তে তাঁত ঋণ না পাওয়ায় ও কাঁচামালের (রং-সুতা) মূল্য বৃদ্ধির কারণে দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার রানীরবন্দরের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে ফলে কয়েকহাজার মালিক দেউলিয়া ও অর্ধলক্ষাধিক তাঁত শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
চিরিরবন্দর উপজেলার নশরতপুর গ্রামের রানীরবন্দর বাজার ব্রিটিশ আমল থেকে তাঁত সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে সারাদেশে পরিচিত ছিল। এখানকার সুদক্ষ তাঁতশিল্পীদের উৎপাদিত তোয়ালা, গামছা, শাড়ি, লুঙ্গি, চাঁদর ও কাপড়জাত অন্যান্য সামগ্রী জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলাসহ রাজধানী ঢাকায় রপ্তানি সুবাদে গড়ে উঠেছিল ছোটবড় শতাধিক তাঁত কারখানা। এ তাঁতশিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল কয়েক হাজার মালিক ও অর্ধলক্ষাধিক শ্রমিক। যে কারণে রানীরবন্দরে গড়ে উঠে রানীরবন্দর (হ্যান্ডলুম বোর্ড) তাঁতি সমবায় সমিতি। তাঁতিরা তাদের অস্তিত্ব টিকে রাখতে চেষ্টা করলেও ভারতীয় কম মূল্যের রংচঙ্গা কাপড়, রং, সুতাসহ কাঁচামালের দাম দফায় দফায় বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁতশিল্প যখন বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে তখন বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড (বেসিক) ১৯৮২ সালে তাঁতশিল্প ও শিল্পীদের রক্ষায় এগিয়ে আসলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। রানীরবন্দরের তাঁতশিল্পী আব্দুল মালেক, আবুল কালাম আজাদ ও আব্দুল খালেক জানান, দুই দশক পূর্বে রানীরবন্দরে আনুমানিক ১৫ হাজার তাঁত মালিক ও প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক তাঁতশিল্পের সাথে জড়িত থেকে জীবিকা নির্বাহ করেছে। বর্তমানে এখানে হাতেগোনা ৬ থেকে ৭ জন তাঁত মালিক ও গুটিকয়েক শ্রমিক তাঁতের সাথে জড়িত আছে।
তারা আরও বলেন, উৎপাদিত কাপড় বাজারজাত করনের তেমন কোন সুযোগ না থাকা, সুতা-রং এর দাম উঠানামা, ভারতীয় কাপড় বাজারে প্রবেশ করা ও বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড তাঁতিদের এককভাবে ঋণ প্রদান না করে দলগতভাবে সর্বোচ্চ একজনকে ১৩ হাজার টাকা ঋণ প্রদান করে থাকে। দলগতভাবে ঋণ নেয়া ও পরিশোধে ব্যাপক জটিলতার শিকার হতে হয়। বাধ্য হয়ে রানীরবন্দরের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পের সুদক্ষ তাঁত শিল্পীরা তাঁতের মেশিন পুরাতন দোকানে কেজি দরে বিক্রি করে পাবনা, কুষ্টিয়া, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে তাঁত শ্রমিক হিসেবে এবং অনেকে গ্রামে গ্রামে সুঁই-সুতা, খেলনা, কসমেটিকস্সহ হরেক রকম দ্রব্যাদি ফেরি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। আবার অনেকে গ্রামেগঞ্জে পুরাতন পলিথিন সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে কেউবা ভ্যান-রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। কেবল এখানকার কয়েকজন তাঁতী কোনমতে বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে ধরে আছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড, বেসিক সেন্টার চিরিরবন্দর (রানীরবন্দর) দিনাজপুরের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা মঞ্জুর হাসান জানান, এই বেসিক সেন্টারের আওতায় বর্তমানে উত্তরাঞ্চলেরর সাত জেলার ৫ হাজার ২’শ তাঁতি তালিকাভুক্ত আছে। এদেরমধ্যে ৩০% তাঁতি তাদের পেশার সাথে জড়িত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে। তিনি তাঁতিদের সাথে একমত পোষণ করে বলেন, তাদের রক্ষায় পর্যাপ্ত সহযোগিতা, তাঁতি ট্রেনিং, ঋন সুবিধা বৃদ্ধি ও উৎপাদিত পণ্য সহজলভ্যে বাজারজাত করা গেলে রানীরবন্দরের তাঁত মালিক শ্রমিকরা আবার কর্মসংস্থান ফিরে পাবে ও দেশি পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে।