আমার দেশ • প্রথম পাতা • লিড ১
শিক্ষার্থীরা ছাড়ছে বিবিএ ঝুঁকছে প্রকৌশলে
মো. আখতারুজ্জামান : প্রতিনিয়ত বাড়ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা। ২০১৩ সালে দেশের ৬৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। ২০১৯ সালে এসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৪টি। সেই হিসেবে ৬ বছরের ব্যবধানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বেড়েছে ২৬টি। গড়ে প্রতিবছর বেড়েছে ৪টিরও বেশি। একটা সময় শিক্ষার্থীদের পছন্দের শীর্ষে ছিলো বিবিএ। এখন সেই অবস্থানে পরিবর্তন এসেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ ডিগ্রিপ্রত্যাশীর চেয়ে বেড়েছে প্রকৌশলী ডিগ্রিপ্রত্যাশী শিক্ষার শিক্ষার্থীদের সংখ্যা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমাদের দেশে একটা সময় বিবিএ পাস শিক্ষার্থীদের চাহিদা ছিলো। ভালো বেতনে চাকরি পাওয়ার একটু সুযোগ ছিলো। ফল যেটা হলো সবাই ঝুঁকলো বিবিএর দিকে। এখন বিবিএ পাস করা শিক্ষার্থীরাই বেশি বেকার। কারণ আমাদের দেশে যে পরিমাণ বিবিএ পাস জনশক্তি প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি পাস করছে।
সূত্রমতে, ২০১৭ সালে দেশে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাকারী ৯০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৩৩৩। সেখান থেকে বেড়ে ২০১৮ সালে ৯১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখ ৬১ হাজার ৭৯২। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ৭ হাজার ৪৫৯। সাবেক শিক্ষা সচিব এন আই খান জানান, আমাদের পাশের দেশে ইন্ডিয়ার তামিলনাড়–তে জেনারেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বেশি। আমাদের দেশে এখনও সেইভাবে হচ্ছে না। সবসময় একটা ধারা প্রবাহিত হয়। যখন যে ধারা চলে সেই ধারাতেই অনেকে গা ভাসায়। একটা সময় বিবিএ পাস শিক্ষার্থীদের চাহিদা ছিলো। ফল যেটা হলো সবাই ঝুঁকলো বিবিএর দিকে। এখন দেখা যায় বিবিএ পাসকৃত শিক্ষার্থীরাই বেশি বেকার। কারণ আমাদের দেশে যে পরিমাণ বিবিএ পাসের প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি পাস করছে।
তিনি বলেন, এখন বিবিএর শিক্ষার্থী কমেছে এটা ঠিক। কারণ এখন অনেকেই প্রকৌশল বেছে নিচ্ছে। এটার পেছনে কারণ হচ্ছে সরকার বেশ কিছু প্রকল্প নিয়েছে যেখানে প্রকৌশলী প্রয়োজন সব থেকে বেশি। বেসরকারি খাতেও তাই। আমাদের দেশে আগের তুলনায় কারখানা বেশি হচ্ছে। আর কারখানা মানেই প্রকৌশলীদের চাহিদা। ফলে এখন প্রকৌশলে ঝুঁকছে শিক্ষার্থীরা। তবে উন্নত বিশ্বে কিন্তু প্রকৌশলীদের সংজ্ঞা ভিন্ন। এসব দেশে যারা হাতেকলমে কাজ করে তারা একটা সময় অতিবাহিত হলে অভিজ্ঞতার আলোকে সনদপত্র পেয়ে যায়। আমাদের দেশে এই পদ্ধতি এখনও সেইভাবে চালু হয়নি। তবে কিছু আছে সেটা আলোর পথ দেখছে না। এটাকে আলোর পথে নিয়ে আসতে হবে। তাহলে আমরা প্রকৌশলীদেরতে যে চাহিদা রয়েছে এটার ভালো একটা অংশ বাস্তব অভিজ্ঞদের কাছ থেকেই পাবো।
ইউজিসির তথ্যমতে, ২০১৩ সালে দেশের ৬৮ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ ডিগ্রিপ্রত্যাশী বা ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থী ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ১১২ জন। এরপর গত কয়েক বছরে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। যদিও এর বিপরীতে ব্যবসা শিক্ষায় স্নাতক করতে আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে। ২০১৯ সালে দেশের ৯৪ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ের শিক্ষার্থী কমে দাঁড়িয়েছে ৮৭ হাজার ৬৯৫ জন। এ হিসেবে ছয় বছরের ব্যবধানে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থী কমেছে ৩৫ শতাংশ। দেশে বেসরকারি খাতে উচ্চশিক্ষার যাত্রা ১৯৯২ সালে। ওই সময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিকাশ ঘটেছিল মূলত বিবিএ ডিগ্রির ওপর ভর করেই। বেসরকারি খাত বিশেষ করে ব্যাংক, বীমা ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোয় তখন ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ কারণে চাকরির বাজারে বিবিএ স্নাতকদের কদর বেড়ে যায়। ফলে সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই বিবিএ প্রোগ্রাম চালু করে। প্রতি বছরই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বিবিএ স্নাতক বের হতে থাকে লক্ষাধিক।
জানা যায়, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালে প্রথম এ সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ ছাড়ায়। এরপর ২০১৬ সালে এ ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে। এরপর আবার গত দুই বছর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমে বেড়েছে। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থী সংখ্যায় সবচেয়ে এগিয়ে ছিল ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। গত বছর ড্যাফোডিলের মোট শিক্ষার্থী ছিল ২১ হাজার ৭৮১। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ছিল ২০ হাজার ১৯৭ জন, যা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তৃতীয় অবস্থানে থাকা ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ৪৩৮। আর সবচেয়ে কম শিক্ষার্থী ছিল ফরিদপুরের টাইমস ইউনিভার্সিটির। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ছিল মাত্র ৭৩ জন।
দেশের আর্থিক ও ব্যবসায়ীক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোয় কর্মসংস্থানের সুযোগ কমেছে। হ্রাস পাচ্ছে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি। বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত মুদ্রানীতিতে নির্ধারণ করা ঋণ প্রবৃদ্ধির ধারেকাছেও যেতে পারছে না বেসরকারি খাত। নতুন কোনো শিল্পোদ্যোগ না থাকায় নতুন কর্মসংস্থানও তৈরি হচ্ছে না। অনেক প্রতিষ্ঠানকেই এখন কর্মীর সংখ্যা কমিয়ে আনতে দেখা যাচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এখন বিবিএ প্রোগ্রামে ভর্তি সংখ্যাও কমছে। এর বিপরীতে প্রকৌশল-সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের প্রায় সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত কয়েক বছরে বিবিএ ডিগ্রিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক বছরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বিবিএ ডিগ্রিধারী বেড়িয়েছে চাকরি বাজারের চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। এজন্য তাদের বড় একটি অংশই কর্মসংস্থানের বাইরে থেকে গিয়েছে। এ কারণে শিক্ষার্থীরা এখন আর বিবিএ পড়তে তেমন আগ্রহী হচ্ছে না। অন্যদিকে এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই গত কয়েক বছরে বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের শিক্ষার্থী বেড়ে গেছে। এর মধ্যে আইইউবি, ইস্ট ওয়েস্ট, এআইইউবি, ইউআইইউতে প্রকৌশল বিষয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি।
রাজধানীর ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. চৌধুরী মোফিজুর রহমান বলেন, এক সময় ইউআইইউর বিবিএতে প্রকৌশলের তিন গুণ শিক্ষার্থী ভর্তি হতো। এখন বিবিএর শিক্ষার্থী অনেক কমে গেলেও প্রকৌশলের শিক্ষার্থীর হার অনেক বেড়েছে। আসলে আমাদের প্রকৌশলের প্রোগ্রামগুলোর আলাদা একটি সুনাম রয়েছে, এজন্যই শিক্ষার্থীরা আগ্রহী হচ্ছে।