অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নারীদের পিছিয়ে থাকা ও রাজনৈতিক নারীবাদ
কাকন রেজা
‘অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নারীর অংশগ্রহণে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে নিচে বাংলাদেশ।’ এটা আমার কথা নয়, প্রথম আলোর খবরের শিরোনাম। দেশের নারীবাদ বিষয়ে দু’কলম উল্টো কথা লিখলেই কারও মনে লেগে যায়। তাদের বলি, এই যে মোল্লা আর জঙ্গিদের দেশ পাকিস্তানকেও এগিয়ে রাখা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে তখন তাদের মনে লাগে না। মনে হয় না, নারীবাদ সত্যিই বাংলাদেশে বেপথু। প্রথম আলো বিশ^ব্যাংকের করা সূচককে উদ্ধৃত করেছে খবরে। নেপাল রয়েছে প্রথম অবস্থানে। নারীদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম নেপালে বেশি। অথচ নেপাল একটি ধর্মরাষ্ট্র। বিশে^র একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র। পঁয়ত্রিশটি প্রশ্নের ভিত্তিতে একশ নম্বর নির্ধারিত হয় আলোচ্য সূচকে। যে প্রশ্ন নারীবাদীদের করা ধর্মের কথিত ব্যাখ্যার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নেপালের হলো আশি দশমিক ছয়। বাংলাদেশের ঠিক আগে রয়েছে পাকিস্তান পঞ্চান্ন দশমিক ছয় নিয়ে। আর বাংলাদেশের, ঊনপঞ্চাশ দশমিক চার। নারীর উন্নয়নে ধর্ম যে বড় বাধা নয় এ সূচক তার প্রমাণ। এতো কট্টর ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তান, সেখানেও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীদের অংশগ্রহণ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি।
সে অনুপাতে কথিত নারীবাদীর সংখ্যা হিসেব করতে গেলে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে অন্তত চার কদম এগিয়ে থাকবে। এখানে কমবস্ত্র পরিধান বিষয়ক আন্দোলন, ‘কামাই থাকলে জামাই লাগে না’ জাতীয় বিপ্লবীদের অভাব নেই। কিন্তু একজন নারীর কর্মসংস্থান, কাজে নারীর সমানুপাতিক অংশগ্রহণ কোনো কিছুতেই এসব নারীবাদীদের আগ্রহ নেই। তবে তাদের আছে গবেষণা ও পরিসংখ্যান। যা মূলত গো-বাসনা এবং পরিদের-সংখ্যান। সাবেক অর্থমন্ত্রীর ভাষায় রাবিশ অ্যান্ড বোগাস। এক সময় ¯েøাগান ছিলো এগারো কোটি মানুষের বাইশ কোটি হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করার। সেই ¯েøাগানে এগারো কোটিকে মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, নারী পুরুষে বিভাজন করা হয়নি। আশির দশকের শেষ ও নব্বইয়ের শুরুর সে ¯েøাগান শূন্য দশকে এসে বিভাজিত হয়ে হলো নারী ও পুরুষের। বলা যায় রীতিমতো ‘কাইজ্জা’ লাগিয়ে দেওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হলো। ওই যে, সোকল্ড ফেমিনিস্টরা মনে করিয়ে দিলো তারা নারী, পুরুষ নয়। শুরু হলো তাদের মানুষ নয়, পুরুষ হওয়ার আন্দোলন। সঙ্গে শুরু হলো গৃহদাহ, ঘরে ঘরে অশান্তি। আর সেই গৃহদাহ সৃষ্টির কারিগর অশান্তি বেগমগণ নিজেরা রইলেন জমিদারের হালতে। বেড়াতে লাগলেন হিল্লি-দিল্লি ঘুরে। অনেকে হয়ে উঠলেন এনজিওওয়ালি। কারও গাড়ি-বাড়ি হলো। কেউ শূন্য থেকে পূর্ণ হয়ে উঠলেন। বিপরীতে আমাদের নারীরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়তে লাগলেন সত্যিকার পরিসংখ্যানে। হতে লাগলেন পদে পদে লাঞ্ছিত। একসময় সামাজিক বাধার কারণে কোনো মেয়েকে প্রকাশ্য লাঞ্ছিত করার সুযোগ ছিলো না।
আর কথিত নারীবাদের প্রবল আধিপত্যে এখন খাদিজাদের প্রকাশ্যে কোপানো হয়। বিশ^বিদ্যালয় পড়–য়া মেয়েকে রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। ভোট না দেওয়ার অপরাধে গণধর্ষণের শিকার হয় গৃহবধু। মাভৈ, বলা ছাড়া আর কী বলতে পারি। গত বছরের সূচকে পাকিস্তান আর বাংলাদেশ সমান অবস্থানে ছিলো। এক বছরে পাকিস্তান ঊনপঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্নতে পৌঁছেছে। বাংলাদেশের অবস্থা তথৈবচ। এ সূচকটি করা হয় চলাচলের স্বাধীনতা, কর্মক্ষেত্রের সমতা, মজুরি, বিবাহ, পিতৃত্ব-মাতৃত্ব, উদ্যোগ, সম্পদ ও পেনশন এসবের ওপর ভিত্তি করে। এই যে আটটি সূচক তা ভালোভাবে পড়ে দেখলেই আমাদের দেশের নারীবাদের রহস্য অনেকটাই উন্মোচিত হবে। বোঝা যাবেÑ এ নারীবাদ মূলত রাজনৈতিক। অনেকে বলবেন, অধিকার আদায়ের সব কাজই রাজনীতি সম্পৃক্ত। অস্বীকার করি না। তবে নারীবাদের রাজনীতি ও রাজনীতির নারীবাদের মধ্যে যে ফারাক রয়েছে সেখানেই পিছিয়ে থাকার রহস্যটা। আর সে রহস্যই উন্মোচনের কথা বলছি। লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট