পাঁচ দশকের বাংলাদেশ : বিশে^র বিস্ময়
ড . আতিউর রহমান
গত ১০ মার্চ কলামিস্ট নিকোলাস ক্রিস্টফ বিশ^বিখ্যাত দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসে লিখেছেন, দারিদ্র্য কী করে কমাতে হয় তা বোঝার জন্য বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশ থেকে শিখতে পারে। বিশেষ করে নারী-শিশুকে শিক্ষিত করে একটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ কী করে এতো অল্প সময়ের মধ্যে তীব্র দারিদ্র্য নিরসন করে এমন মাথা উঁচু করে তরতর করে উন্নয়নের মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তা সত্যি অনুসন্ধানের বিষয়। এবারের মার্চে মহামারির মধ্যেও যুগপৎ মুজিব-বর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে বাংলাদেশ। এমন সময়ে এমন প্রশংসনীয় কথা শুনতে কার না ভালো লাগে। তাও আবার বিশে^র প্রভাবশালী গণমাধ্যম থেকে। মাত্র কয়েকদিন আগেই আরেক বিখ্যাত মার্কিন দৈনিক ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল লিখেছে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গতিময় (বুলরানিং কেইস) দেশ হতে যাচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও ভিয়েতনামের মতো রপ্তানিনির্ভরশীল এশীয় উন্নয়ন মডেলের প্রতি ছবি বাংলাদেশের মাঝে এই পত্রিকার কলামিস্ট দেখতে পাচ্ছেন। মাথাপিছু আয় এবং ক্রমবর্ধমান রপ্তানি আয়ের ওপর ভর করে বাংলাদেশ এমন চমকে দেওয়া উন্নয়নের গতিময় ধারা সচল রেখেছেন বলে তিনি মনে করেন।
এর আগে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গ পরিচালিত কোভিড-১৯ সংকট ব্যবস্থাপনার সাফল্য মাপার ব্লুমবার্গ রেজিলিয়েন্স সূচকে বাংলাদেশ বিশে^র প্রথম বিশটি দেশের তালিকায় নিজেকে যুক্ত করতে পেরেছে। করোনা প্রতিরোধের টিকা ব্যবস্থাপনাতেও বাংলাদেশ দারুণ পারফর্ম করছে। জাতিসংঘের মহাসচিব, বিশ^ স্বাস্থ্যসংস্থার প্রধানসহ বিশ^ নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। নেতৃত্বের গুণেই বাংলাদেশ এমন অসামান্য অর্জন করে যাচ্ছে তাবলাই বাহুল্য। তাই তো কমনওয়েলথ মহাসচিব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কমনওয়েলথ অঞ্চলের তিন সফলতম নারী নেত্রী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
ফিরে আসি পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক ক্রিস্টফের কথায়। তার মতে, ‘গরিব মানুষের পেছনে বিনিয়োগ করেই বাংলাদেশ এ সাফল্যের ভিত্তি তৈরি করেছে’। বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুই প্রাথমিক শিক্ষার অবারিত সুযোগ পাচ্ছে। বিশেষ করে নারী-শিশুরা বেশি করে সরকারের দেওয়া শিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করছে। যার ফলে মাধ্যমিক শিক্ষায় মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে বেশি হারে পড়ছে। এ মেয়েরাই এখন গ্রাম থেকে শহরে এসে পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানায় কাজ করছে। আঠারো বছরের আগে বিয়ে না করে তারা আনুষ্ঠানিক কর্মে যুক্ত হচ্ছে। কাজ করে করেই তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাই তাদের দক্ষতাও বাড়ছে। আর বাড়ছে উৎপাদনশীলতা। সরকার এবং সরকারের বাইরের অনেক সামাজিক উন্নয়নে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান মিলেই নারীশিক্ষা এবং দারিদ্র্য নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। কর্মজীবী এ নারী শুধু তাদের পরিবারের দারিদ্র্য ঘোচাচ্ছে সেটিই গল্পের পুরোটা নয়।
একইসঙ্গে তারা তাদের পরিবারে ও সমাজে নারীর ক্ষমতায়নের গতিকে বেগবান করছে। নিজেদের ভাই-বোন ও সন্তানদের পড়াশোনার সুযোগও করে দিচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নিয়মিত টাকা পাঠিয়ে পরিবারের ভোগের স্থিতিশীলতা বজায় রাখছে। গ্রামীণ চাহিদা চাঙা করে রেখেছে। বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের ব্যবস্থা ছাড়াও বোন ও মায়েদের স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে বাঁচবার সংস্কৃতিও গড়ে তুলতে সাহায্য করছে। বঙ্গবন্ধুর নীতির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমতে কমতে এক শতাংশে নেমে এসেছে। প্রতি দম্পতির এখন গড়ে দুটি সন্তান। অথচ বাহত্তরে এ সংখ্যা ছিলো ছয়। দেশে এখন ঘর ছাড়া পরিবার নেই বললেই চলে। যাও-বা আছে তাদের জন্য সরকার প্রধান বিশেষ কর্মসূচির অধীনে মানসম্মত ঘর করে দিচ্ছেন। কৃষিতে এ পঞ্চাশ বছরে উৎপাদন বেড়েছে চার গুণের মতো। মাছ, মাংস, দুধ, সবজি, ফল উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। যে লড়াকু মন জাতির জনক আমাদের দিয়ে গেছেন, তাকে পুঁজি করেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে তর তর করে।
বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি তার প্রিয় বাংলাদেশে পা রাখলেন বীরের বেশে। অঙ্গীকার করলেন শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির সোনার বাংলা গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দুঃখী মানুষের দুঃখ মোচনের। বলেছিলেন, এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি মানুষকে খাবার এবং কাজ না দিতে পারেন। তাই কালবিলম্ব না করে তিনি লেগে পড়লেন দেশ গড়ার কাজে। বাহাত্তরে শূন্য হাতেই বঙ্গবন্ধু তার উন্নয়ন অভিযাত্রা শুরু করেন।
এক ডলারও রিজার্ভ নেই। রাস্তাঘাট, সেতু, রেল, বন্দরসহ প্রায় সকল অবকাঠামো বিধ্বস্ত। তা সত্ত্বেও তাকে এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসনের কাজটি হাতে নিতে হয়। কৃষি ও শিল্পের পুননির্মাণ শুরু করতে হয়। উদ্যোক্তা বিহীন বাংলাদেশে শিল্পের রাষ্ট্রীয়করণ ছিলো অবধারিত। কৃষির আধুনিকায়নে তিনি উন্নত বীজ, সার ও সেচের ব্যবস্থা করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলেন। কুদরত-ই-খুদা কমিশন করে উপযুক্ত নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির জন্য তৎপর হন। কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দেন। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বের কূটনীতি চালু করে বাংলাদেশকে সুপরিচিত করেন। বিশ^ব্যাংক, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সদস্য করেন বাংলাদেশকে। দ্রুতই সংবিধান ও প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা চালু করে পরিকল্পিত উপায়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন কৌশলকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ভারসাম্যপূর্ণ করার সুদূর প্রসারী উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও বৈরী যুক্তরাষ্ট্রের নানা ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে থাকে। মাত্র সাড়ে তিন বছরেই মাথাপিছু আয় ৯৩ ডলার থেকে ১৯৭৫ সালে ২৭৩ ডলারে উন্নীত হয়। কৃষি উৎপাদনে গতি আসতে শুরু করে। সবুজ বিপ্লবের সূচনা হয়। আইনশৃঙ্খলা সুরক্ষা এবং সাম্যের অর্থনীতি পরিচালনার জন্য বিকেন্দ্রায়িত প্রশাসন ও অর্থনীতি পরিচালনার উদ্দেশে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু শত্রুরা বঙ্গবন্ধুর এ অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট।
শারীরিকভাবে হারিয়ে ফেলি তাকে। কিন্তু তিনি থেকে যান আমাদের নিঃশ^াসে-প্রশ^াসে। ষড়যন্ত্রকারীদের নির্বাচনে পরাস্ত করে বঙ্গবন্ধুকন্যা ক্ষমতায় আসেন ১৯৯৬ সালে। বাংলাদেশ ফিরতে থাকে বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের উন্নয়নের পথে। ব্যক্তি খাত ও সরকারি খাত মিলেমিশে উন্নয়নের এক ভারসাম্যময় কৌশল গ্রহণ করে বাংলাদেশ। সামাজিক সুরক্ষার নীতি চালু করা হয় গরিব-দুঃখী মানুষের কল্যাণের জন্য। দেশ ফিরে আসতে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষার পথে।
ফের ছন্দ পতন ২০০১ সালে। নানা আঘাত আক্রমণ মোকাবেলা করে ফের বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশ পরিচালনার সিটে বসেন ২০০৯ সালে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। গত এক যুগে বিস্ময়কর পরিবর্তন এসেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে সাড়ে তিনগুণ। রপ্তানি বেড়েছে চার গুণ। প্রবাসী আয় বেড়েছে তিনগুণের মতো। পঁচাত্তরের পর রেমিটেন্স বেড়েছে ২৮৫ গুণএবং রপ্তানি বেড়েছে ১৩৩ গুণ। গত বারো বছরে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে প্রায় সাত গুণ। গত পঞ্চাশ বছরের হিসেব নিলে দেখাযায় যে ৭৫ পরবর্তি প্রবৃদ্ধির ৭৩ শতাংশই হয়েছে গত একযুগে। গত পাঁচ দশকে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ। ব্যক্তি খাতে বস্ত্র শিল্পের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। পূর্ব এশিয়ার অনুরূপ কম দক্ষ নারী শ্রমিক নির্ভর শিল্পায়ন বাংলাদেশকে প্রতিযোগী করে তুলেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে আর্থিক খাত ও প্রশাসন গতিময় ও অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে।
মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের গতি বেড়েছে। কৃষি আধুনিক হয়েছে। করোনাকালেও এ খাত ভালো করছে। ক্ষুদে ও মাঝারি শিল্পের দেওয়া প্রণোদনা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে বৃদ্ধির হার আরও বাড়বে। বিদ্যুতের প্রসার তো চোখেই পড়ছে। শিক্ষাখাতে ব্যাপক সংখ্যাগত উন্নতি হলেও গুণমানের উন্নতি এখনও চ্যালেঞ্জিং রয়ে গেছে। রাস্তা-ঘাটের আরও উন্নতিকাম্য। বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়লেও বিতরণ সমস্যা রয়ে গেছে। আগামী দিনে সবুজ বিদ্যুতের দিকে আরও বেশি করে মনোযোগ দিতে হবে। আগেই বলেছি, বাংলাদেশ কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সাফল্য দেখিয়ে চলেছে।
বাংলাদেশে গড় আয়ু বাড়ছে, শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার কমেছে, অপুষ্টির হার কমেছে। বেসরকারিখাত এবং সরকারি খাত মিলেই এই সাফল্য বয়ে এনেছে। এভাবে চললে সোনার বাংলা অর্জন খুব দূরে নয় বললে ভুল হবে না।
লেখক : ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর