আমার দেশ • নগর সংস্করণ • প্রথম পাতা • লিড ১
করোনায় আম বিপণনে নিতে হবে গতবারের মতো ব্যবস্থা আশা ও নিরাশার দোলাচলে দেশের আম চাষিরা
মতিনুজ্জামান মিটু : এখনও যা দেখা যাচ্ছে তাতে এবার দেশে আমের ফলন ভালো হবে। ঝড় ছাড়া একটু বৃষ্টি হলে অনিশ্চয়তা কেটে যেতো, আরও ভালো হতো। করোনার তীব্রতায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে আম বিপণনে গত মৌসুমের মতো ব্যবস্থা না নিলে বিপাকে পড়বে চাষিরা।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের ফল বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শরফ উদ্দিন বলেন, ভালো ফলনের জন্য এখন বাগানে সেচ ও সঠিক গ্রুপের কীটনাশক দেওয়া দরকার। এই সঙ্গে পোস্ট অফিসের মাধ্যমেসহ আম পরিবহনে গতবছরের করোনা পরিস্থিতির মতো ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি জানান, আম এ দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল। ছোট-বড় সবার পছন্দনীয় এই ফলটির উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। স্বাদ ও জনপ্রিয়তার জন্য আমকে বাংলাদেশে ফলের রাজা বলা হয়। পুষ্টি উপাদান ও বহুবিধ ব্যবহারের কারণে অন্য কোন ফলের সঙ্গে আমের তুলনা হয় না। পাকা আম উচ্চমানসম্পন্ন ক্যারোটিন বা ভিটামিন এ এবং খনিজ উপাদান সমৃদ্ধ। আম সাধারণত বাংলাদেশের সব এলাকায় আবাদ হয়, তবে উঁচু মান, স্বাদ ও অধিক উৎকৃষ্ট আম চাষের উপযোগী মাটি ও কৃষি জলবায়ুর জন্য দেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে সর্বাধিক আম আবাদ হয়। বর্তমানে কিছু কিছু পাহাড়ি এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উচ্চফলনশীল মানসম্পন্ন আমের চাষাবাদ হচ্ছে। আম ওই এলাকার মানুষের আয়ের অন্যতম উৎসে পরিণত হয়েছে। বিবিএস, ২০১৭ অনুযায়ী দেশে ৩৭৮৪৬ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়, যার উৎপাদন প্রায় ১১.৬১ লাখ মেট্রিক টন। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী আম চাষাবাদের এলাকা ও উৎপাদন উভয়ই বেশি। তাদের মতে, ১ লাখ ৭৪ হাজার ২০৮ হেক্টর জমিতে আমের চাষাবাদ হয় এবং এর উৎপাদন ২১ লাখ ৪৩ হাজার ৪০৩ মেট্রিক টন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাতে ৩১ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়, যার উৎপাদন প্রায় ৩ লাখ মেট্রিক টন। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ হতে আমের বাণিজ্যিক চাষাবাদ সম্প্রসারিত হয়েছে ২৩টি জেলায়। অন্য ফসলের তুলনায় লাভজনক হওয়ায় নতুন নতুন জেলায় আম বাগান বাড়ছে।
বিভিন্ন জেলায় আমের বর্তমান অবস্থা ভিন্ন ধরনের। কোনো জেলায় আম এখন গুটিবাঁধার শেষের পর্যায়ে। আমের গুটি বাঁধা শেষ হলেই সঠিক গ্রুপের কীটনাশক ও ছত্রাকনাশকের ব্যবহার করতে হবে। মেঘমুক্ত ও রৌদ্র উজ্জ্বল দিনে স্প্রে করলে তা বেশি কার্যকর হয়। তবে স্প্রে হতে সবচেয়ে বেশি সুফল পেতে সঠিক বালাইনাশক নির্বাচন, সঠিক ডোজ বা মাত্রা নির্ধারণ, সঠিক সময় নির্বাচন এবং সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। তবে কোনও কোনও আম উৎপাদনকারী এলাকায় আম উৎপাদনে ককটেলের ব্যবহার করে থাকেন। ককটেল বলতে একাধিক কীটনাশক, ছত্রাকনাশক ও হরমোনের একত্রে ব্যবহারকে বোঝানো হয়েছে।
তাদের মতে, একটি কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক কোনো একটি রোগ ও পোকামাকড় দমনে যথেষ্ট নয়। যদিও সংশ্লিষ্ট গবেষকদের মতে, এই ককটেল কখনও কার্যকরী হতে পারে না। তাদের মতে, যে কোনো বালাইনাশক যদি পরিমিত মাত্রায় কার্যকরী উপাদান থাকে এবং সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করা হয় তাহলে নির্দিষ্ট বালাইনাশক নির্দিষ্ট সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট। এখন থেকে আম সংগ্রহ করা পর্যন্ত আমবাগানে বহুবার বালাইনাশক ব্যবহার করা দরকার হয়।
আমের বৃদ্ধিকালীন সময় বর্ষাকাল হওয়ায় বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা যায়। আর এসবের আক্রমণ থেকে আমকে রক্ষা করেতে বালাইনাশকের ব্যবহার বেড়ে যায়, যা মোটেই কাংখিত নয়। এখন সবার প্রচেষ্টা কিভাবে সবচেয়ে কম বালাইনাশক ব্যবহার করে ভালোমানের আম উৎপাদন করা যায়। প্রথমেই যেটি আসে তা হলো সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা।
আমবাগান সব সময় পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখতে হবে। মরা ডালপালা কেটে ফেলতে হবে। আলোক ফাঁদ, ফেরোমন ফাঁদ ও হলুদ ট্রাপ ব্যবহার করতে হবে। ফেরোমন ফাঁদ পদ্ধতিটি আমের মাছি পোকা দমনে বেশ কার্যকর। তবে সবাই মিলে একত্রে ব্যবহার করলে সুফল পাওয়া যায়। সবশেষে বালাইনাশকের ব্যবহার করতে হবে।
বৃষ্টিবহুল দেশে ঐ পদ্ধতিগুলো ততটা কার্যকর নয় ফলে চাষিরা বালাইনাশকের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল। তবে বিগত কয়েক বছর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এর উদ্ভাবিত ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তিটি ভালো মানের আম উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। ধারাবাহিকভাবে সুফল পাওয়ায় এই প্রযুক্তিটি ইমিধ্যেই সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি হিসেবে মাঠপর্যায়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে।