সরকারের কোষাগারে ফেরত গেছে জীবনমান উন্নয়ন প্রশিক্ষণের টাকা
মতিনুজ্জামান মিটু : করোনার কারণে এখন আর আগের মত ক্রেতারা বাড়িতে ঢুকতে দেন না। চলছে না সাপের খেলা। তাবিজ-কবজ বিক্রিসহ আর সব আয়ের পথও বন্ধ। লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় দূর-দূরান্তে যাওয়াও সম্ভব হয় না। আয় নেই যাযাবর এ জনগোষ্ঠির অধিকাংশ বেদে পরিবারের। তাই অনেক সময়ে বেদে ও বেদেনিরা ভাত আর আলু সেদ্ধও তুলে দিতে পারছেন না তাদের ছেলে মেয়েদের মুখে। করোনায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ৩ কোটি টাকা এবং ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হলেও তা ছিলো নিতান্তই অপ্রতুল। এদিকে করোনার প্রভাবে সরকারের নেওয়া বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়নি। কোষাগারে ফিরে গেছে দেশের ৬৪ জেলায় ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ ৫৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকার মধ্যে প্রশিক্ষণের ১২ কোটি ১১ লাখ টাকা। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের এ কর্মসূচির প্রশিক্ষণের টাকাও সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়া হতে পারে। কারণ করোনায় এ প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হয়নি।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা অধিশাখার উপপরিচালক (বেদে, অনগ্রসর ও হিজড়া জনগোষ্ঠি) মো. শাহ জাহান জানান, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ। সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপমতে বাংলাদেশে প্রায় ১৩ লাখ ২৯ হাজার ১৩৫ জন অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এবং ৭৫ হাজার ৭০২ জন বেদে জনগোষ্ঠী রয়েছে। জেলে, সন্যাসী, ঋষি, বেহারা, নাপিত, ধোপা, হাজাম, নিকারী, পাটনী, কাওড়া, তেলী, পাটিকর, বাঁশফোর, ডোমার, রাউত, তেলেগু, হেলা, হাড়ি, লালবেগী, বাল্মিগী, ডোম ইত্যাদি তথাকথিত নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠী এ অনগ্রসর সম্প্রদায়ভুক্ত। যাযাবর জনগোষ্ঠী বেদে সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। বেদে জনগোষ্ঠীর শতকরা ৯৯ ভাগ মুসলিম এবং শতকরা ৯০ ভাগ নিরক্ষর। ৮টি গোত্রে বিভক্ত বেদে জনগোষ্ঠীর মধ্যে মালবেদে, সাপুড়িয়া, বাজিকর, সান্দার, টোলা, মিরশিকারী, বরিয়াল সান্দা ও গাইন বেদে ইত্যাদি। এদের প্রধান পেশা হচ্ছে ক্ষুদ্র ব্যবসা, তাবিজ-কবজ বিক্রি, সর্প দংশনের চিকিৎসা, সাপ ধরা, সাপের খেলা দেখানো, সাপ বিক্রি, আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য সেবা, শিংগা লাগানো, ভেষজ ঔষধ বিক্রি, কবিরাজি, বানর খেলা, যাদু দেখানো প্রভৃতি।
২০১২-২০১৩ অর্থ বছরে পাইলট কর্মসূচির মাধ্যমে ৭টি জেলায় বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়। পাইলট কার্যক্রমভুক্ত ৭টি জেলা হচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, পটুয়াখালী, নওগাঁ, যশোর, বগুড়া এবং হবিগঞ্জ । ২০১২-১৩ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৬৬ লাখ টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে নতুন ১৪ জেলাসহ মোট ২১টি জেলায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয় এবং জেলাগুলো হচ্ছে ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, শেরপুর, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, কুমিল্লা, পাবনা, নওগাঁ, দিনাজপুর, নীলফামারী, যশোর, কুষ্টিয়া, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী এবং হবিগঞ্জ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৭ কোটি ৯৬ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আগের ২১ জেলায় এ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বরাদ্দকরা অর্থের পরিমাণ ৯ কোটি ২২ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ৬৪ জেলায় সম্প্রসারণ করা হয়েছে এবং বরাদ্দকরা অর্থের পরিমাণ ১৮ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৬৪ জেলায় বরাদ্দকরা অর্থের পরিমাণ ৫০ কোটি ০৩ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ৬৪ জেলায় বরাদ্দকরা অর্থের পরিমাণ ৫৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।
কর্মসূচির উদ্দেশ্যের মধ্যে ছিলো; স্কুলগামী বেদে ও অনগ্রসর শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে লক্ষ্যে ৪ স্তরে (জনপ্রতি মাসিক প্রাথমিক ৭০০, মাধ্যমিক ৮০০, উচ্চ মাধ্যমিক ১০০০ এবং উচ্চতর ১২০০ টাকা হারে) উপবৃত্তি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষম বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বৃদ্ধি ও আয়বর্ধনমূলক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করে তাদের সমাজের মূলস্রোতধারায় আনা। ৫০ বছর বা তদুর্ধ্ব বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল ব্যক্তিকে বিশেষ ভাতা জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা দেওয়া। প্রশিক্ষণোত্তর পুর্নবাসন সহায়তা ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া। কর্মসূচির আওতায় ১৮ বছর বয়সের উর্ধ্ব কর্মক্ষম ব্যক্তিদেরকে ট্রেডভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণার্থীদেরকে প্রশিক্ষণোত্তর অফেরতযোগ্য আর্থিক সহায়তা সহায়তা দেওয়া হয়।
এ কর্মসুচি বাস্তবায়নে বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমানের কতটুকু উন্নয়ন হয়েছে তা জানতে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ২০১৯-২০ অর্থবছরে মূল্যায়ন কার্যক্রম শুরু করেছে। এ কার্যক্রম শেষে প্রতিবেদন দেওয়া হবে। আর তাতেই উঠে আসবে দেশের বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠির কি উন্নয়ন হয়েছে? সম্পাদনা : ভিক্টর রোজারিও