হাচ সেলুলারের জনপ্রিয় সেই বিজ্ঞাপন ফোনের চেয়েও বেশি পরিচিত হয়েছিলো চিকা নামের কুকুরটি
সালেহ্ বিপ্লব : ২০০৩ সালে সেলুলার নেটওয়ার্ক হাচিনসন তাদের বিজ্ঞাপনে এনেছিলো চিকা নামের একটি কুকুর। চিকা এতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে গোটা ভারতে, যা কল্পনাতীত। বিজ্ঞাপনে ছোট্ট একটি ছেলে শহর-গ্রাম, সাগর-পাহাড় সব চষে বেড়ায়। তার পিছে পিছে থাকে চিকা। বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল ‘ইউ এন্ড আই ইন দিস বিউটিফুল ওয়ার্ল্ড। আর স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ট্যাগলাইন, ‘হোয়ারএভার ইউ গো, আওয়ার নেটওয়ার্ক ফলোস।’ দ্য প্রিন্ট, বিজনেস টুডে, ইন্ডিয়া টুডে, হিন্দু বিজনেস
এই বিজ্ঞাপনে ব্রান্ডিং-এর কোনো বিষয় নেই। কোনো কিছু বিক্রির কথাও নেই। হাচ-এর বিজ্ঞাপনটির এটাই হচ্ছে ম্যাজিক, যা হাজার বছর ধরে ভারতে টিকে থাকবে বলে মনে করা হয়।
ব্যাঙ্গালুরুভিত্তিক একটি কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অভিষেক সনোয়াল। তিনি হাচ-এর বিজ্ঞাপনটি স্মরণ করতেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন!
তার ভাষায়, আমি এডটি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ছোট্ট বালক তখন! আমি চাইতাম আমার কুকুর লেক্সি আমাকে চিকার মতো সর্বক্ষণ অনুসরণ করুক। কিন্তু লেক্সির পক্ষে আদৌ সেটি সম্ভব ছিলো না। পরে আমি তাকে এটাওটার লোভ দেখিয়ে আমার পেছনে পেছনে ঘোরানো শুরু করালাম। তবে এতে করে খুব একটা যে লাভ হলো, তা নয়। তবুও লেক্সা যখন আমার পিছে হাঁটতো, আমি কল্পনায় ভেবে নিতাম, আমি বিজ্ঞাপনের সেই বালকটি, আর আমার লেক্সি হচ্ছে চিকা।
হাচ-এর এই প্রচারাভিযান তুমুল জনপ্রিয়তার পাশাপাশি পুরস্কারও জিতেছে। ভারতে ২০০৩ সালে এটি ছিলো পত্রিকার সেরা বিজ্ঞাপন। সেই সঙ্গে টেলিভিশনের সেরা ১০ বিজ্ঞাপনের অন্যতম ছিলো।
এই প্রচারাভিযানের দায়িত্বে ছিলো ওগিলভি এন্ড ম্যাথার (ওএন্ডএম)। বিজ্ঞাপনের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিলো একটি টেলিফোন নেটওয়ার্কের কথা বলা, যেই নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে দেশের যে কোনো স্থান থেকে।
এই প্রচারাভিযানে ওএন্ডএম এজেন্সির ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর মহেশ ভি এবং রাজীব রাও।
তারা আবেগকে ব্যবহার করে প্রযুক্তিকে বাজারজাত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেছেন। যেখানেই যান, হাচ নেটওয়ার্ক প্রিয় কুকুরটির মতো আপনার সঙ্গে থাকবে- এটাই সেই আবেগ।
বিজ্ঞাপন টিম প্রথমে ভেবেছিলো একটি ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে, যে ছায়ার মতো তার বড়ো ভাইকে অনুসরণ করে। পরে বোনের জায়গায় পোষা কুকুরের কথা ভাবেন নির্মাতারা, সেটিই চূড়ান্ত হয়।
ভারতের বিজ্ঞাপনী জগতের কিংবদন্তী অলীক পদমসী মনে করেন, হাচ-এর বিজ্ঞাপনটির সৃষ্টিশীল বৈপরীত্যই এর অসামান্য সাফল্যের কারণ। তিনি বিষয়টির ব্যাখ্যা করেন এভাবে, শংকর জাতের কুকুরটিকে বিজ্ঞাপনে খুব কম দেখা যায়, কারণ এটি দেখতে কুৎসিৎ। আর এখানেই বিজ্ঞাপনটির সাফল্যের মূল।
বিজ্ঞাপনটি তৈরির সময় ওএন্ডএম এজেন্সির ন্যাশনাল ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ছিলেন পীযুষ পা-ে। তার মতে, সরলতাই এর সাফল্যের মূলমন্ত্র। তিনি উল্লেখ করেন, এর পর পরই ভারতে পাগ কুকুরের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যায়, দ্বিগুণ হয়ে যায় শংকর জাতের কুকুরটির বিক্রি। একেকটার দাম পড়তো ১০ হাজার থেকে ৬০ হাজার রুপি। প্রায় ৫০ হাজার পাগ কুকুর আসে ভারতে, যার একটা বড়ো অংশ চোরাইপথে।
ভারতের অনেক বাড়িতে পাগ কুকুরের আগমন ঘটে, তবে নতুন দেশে ততোটা সুখকর ছিলো না কুকুরের জীবন। প্রাণীঅধিকার সংরক্ষণবাদীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন, যাদের মধ্যে ছিলেন মানেকা গান্ধী। তিনি সতর্ক করে বলেন, হঠাৎ করে একটি প্রজাতির কুকুরের সংখ্যা এভাবে বেড়ে যাওয়াটা ঠিক নয়। এরা ভারতের স্থানীয় কুকুর নয়। এদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে কি না, এটা বড়ো ব্যাপার।
পাগ কুকুরের শারীরিক সামর্থ্যরে কথাও মনে করিয়ে দেন মানেকা গান্ধী। পাগ অত্যন্ত দুর্বল গড়নের, চোখে সমস্যা আছে, চর্মরোগ হয়, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, ¯œায়ুরোগও আছে। এরা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান জন্ম দিতে পারে না, সিজার করতে হয়। ভারতে আনার পর বিক্রেতারা এই কুকুরের স্পেশাল কেয়ার নেয় কি না, এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন আরো অনেকেই।
ডগসইন্ডিয়াডটকমের পরিচালক আর পদ্মচন্দ্রন উদ্বিগ্ন এই ভেবে, ভারতের গরম আবহাওয়ায় পাগ কুকুর টিকতে পারবে কি না।
২০০৭ সালে হাচিনসন কোম্পানি চলে যায় ভোডাফোনের মালিকানায়। ২০১৮ সালে ভোডাফোন চিকা নামের কুকুরটাকে ফের প্রচারাভিযানে নামাতে চেয়েছিলো, কিন্তু তাতে বাধ সাধে পেটাইন্ডিয়া। সংস্থার সিইও এক টুইট বার্তায় শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত কুকুরটিকে বিজ্ঞাপনে ব্যবহার না করার আবেদন জানান।
পেটাইন্ডিয়ার আবেদনটি অগ্রাহ্য করার কোনো সুযোগ ছিলো না। ভারতে ২০০৩ সালে যখন পাগ কুকুর আমদানি হলো বানের জলের মতো, তখন অনেক কুকুর কষ্ট পেয়েছে। শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে তার যে বিশেষ যতœ দরকার, সেটা অনেক পরিবারেই করা হয়নি। আবার অনেকে এতো সেবাযতœ চাওয়া কুকুরকে জঞ্জাল বলেই মনে করেছেন, ফিরিয়ে দিয়েছেন পেট শপে।