২০২০ সালে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার চেষ্টায় ২২৭ পরিবেশ রক্ষক নিহত
শোভন দত্ত : গত বছর জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বন, পানি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার চেষ্টা করায় হত্যা করা হয়েছে ২২৭ জনকে। নতুন এ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী পরিবেশ রক্ষকদের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক বছর ছিল ২০২০। পরিবেশ ও মানবাধিকার পর্যবেক্ষক সংস্থা গ্লোবাল উইটনেস গত বছরের তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করে। পরিবেশ রক্ষকদের উপর প্রাণঘাতী হামলার সাথে জড়িত এ তথ্যগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি সপ্তাহে গড়ে চারজনের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
লাতিন আমেরিকায় বেশিরভাগ মৃত্যু ঘটেছে বলে জানিয়েছে গ্লোবাল উইটনেস। সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, কলম্বিয়া ছিল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। আদিবাসীদের জমি বা বন এবং তাদের কোকা ফসল রক্ষা করতে যেয়ে ৬৫ জন নিহত হয়েছে। এছাড়া, মেক্সিকোতে হত্যা করা হয় ৩০ জনকে। দেশটিতে মোট মৃত্যুর সংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মৃত্যু বন উজাড়ের সাথে যুক্ত।
এই অঞ্চলের বাইরের একমাত্র দেশ হিসেবে ফিলিপাইন ১৫ জনের বেশি মৃত্যুর রেকর্ড করেছে। খনন, লগিং এবং বাঁধ প্রকল্প বন্ধ করার চেষ্টার জন্য সেখানে ২৯ জনকে হত্যা করা হয়। গ্লোবাল উইটনেসের তথ্যমতে, ২০২০ সালে পরিবেশগত হামলার অর্ধেকেরও বেশি হামলা সংঘটিত হয়েছে এ তিনটি দেশে।
কিছু ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্য গ্লোবাল উইটনেসকে জানান, মহামারির সময় লকডাউনের কারণে পরিবেশ রক্ষাকর্তারা তাদের নিজের বাড়িতেই আক্রমণের শিকার হন। এদিকে চলমান জলবায়ু সংকটের ফলে কমে যাচ্ছে বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ। গত আগস্টে বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, পৃথিবী পূর্বের ধারণার চেয়ে অনেক দ্রুত উষ্ণতর হচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি নিঃসরণ দ্রুত না কমানো হলে প্রয়্যজনীয় বাস্তুসংস্থান এবং প্রাকৃতিক সম্পদ অপরিবর্তনীয় পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে পারে।
প্রতিবেদনের একজন লেখক ক্রিস ম্যাডেন বলেন, এটি স্পষ্ট যে জলবায়ু সংকট ও লোভ মানুষের উপরও অনেক বেশি প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি ব্যাপক নগরায়ন এবং শিল্পায়নের কারণে অনেক দেশেই পানির অভাব দেখা দিয়েছে। কলোরাডো নদীতে প্রথমবারের মতো পানি সংকটের কারণে দক্ষিণ-পশ্চিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি মেক্সিকোর কিছু অংশও প্রভাবিত হয়েছে। মেক্সিকো সহ পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৪ কোটি মানুষকে পানি সরবরাহ করে এ নদী।
এদিকে গ্লোবাল উইটনেস অনুসারে, ৭০ শতাংশেরও বেশি আক্রমণের ঘটনা ঘটে বন রক্ষাকারী মানুষের উপর। তাদের মতে, বনভূমি ধ্বংস ও শিল্পায়নে বাধা দেওয়া, এবং নদী, মহাসাগর সহ অন্যান্য উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্র রক্ষার প্রচেষ্টার জন্য হত্যা করা হয় এসকল মানুষকে।
এছাড়া, পানির অধিকার, বাঁধ নির্মাণ এবং খনির বিরুদ্ধে লড়াই করতে যেয়ে ব্রাজিল, নিকারাগুয়া, পেরু এবং ফিলিপাইনে ২৩টি হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে।
গত বছর ৩০ শতাংশেরও বেশি প্রাণঘাতী হামলার ঘটনা ঘটে আদিবাসীদের সাথে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ আদিবাসী।
এদিকে, আফ্রিকার পরিবেশবাদী কর্মীরাও একই ধরণের সহিংসতার সম্মুখীন হচ্ছে। গত বছর এ মহাদেশে ১৮ জন পরিবেশ রক্ষাকারীকে হত্যা করা হয়, যেখানে ২০১৯ সালে হত্যা করা হয়েছিল ৭ জনকে। এই হামলাগুলোর বেশিরভাগই গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গোতে ঘটেছে। বাকিগুলো ঘটেছে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং উগান্ডায়।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২০ সালে নিহত ১০ জন রক্ষাকারীর মধ্যে একজন ছিলেন নারী। এর আগে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের ২০২০ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত অবনতি নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বাড়িয়ে তুলছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, হত্যাকা-ের শিকার হওয়ার ছাড়াও অনেক রক্ষক এবং সম্প্রদায়কে বিভিন্ন হুমকি, নজরদারি, যৌন সহিংসতার মতো কৌশল দিয়ে দমিয়ে রাখা হয়। এমনকি এ ধরণের হামলাগুলো রিপোর্ট করা হয় আরও কম। এদিকে গ্রাসরুট গ্লোবাল জাস্টিস অ্যালায়েন্সের পলিসি ডিরেক্টর অ্যাড্রিয়েন সালাজার বলেন, রিপোর্টের ফলাফল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কী ঘটছে সেটিও প্রতিফলিত করে। যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটায় এনব্রিজ লাইন পাইপলাইনের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি অবকাঠামো সম্প্রসারণের প্রতিবাদে আদিবাসী আয়োজকদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।
বিশ্বব্যাপী উত্তরাঞ্চলের কর্মীরা ক্রমবর্ধমান অপরাধের মুখোমুখি হচ্ছে, অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী দক্ষিণের পরিবেশ রক্ষকরা মৃত্যুর ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। এই রক্ষাকর্তারা – বিশেষ করে আদিবাসী পরিবেশ রক্ষকরা আমাদের ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য তাদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলছে, সিএনএনকে বলেন সালাজার।
গ্লোবাল উইটনেস ২০১২ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে পরিবেশগত হামলাগুলো নথিভুক্ত করে চলেছে। তবে, হত্যাকা-ের এ সংখ্যা বাস্তবে আরও বেশি হতে পারে বলে তাদের ধারণা। প্রতিবেদনের লেখকরা এবং সালাজার সতর্ক করেছেন যে জলবায়ু সংকট যত তীব্র হচ্ছে, ততই এটি বন্ধ করার চেষ্টাকারীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ বাড়ছে।
সালাজার বলেন, প্রতিটি জীবন এবং প্রতিটি কাহিনী গুরুত্বপূর্ণ। সূত্র : সিএনএন, টিবিএস, বাংলানিউজ