করোনায় দেশের ৪০ শতাংশ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান বন্ধ
সুজন কৈরী : করোনা মহামারির দরুণ বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। গত বছরের মার্চ থেকে সভা-সেমিনারসহ সকল সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনার প্রাদুর্ভাবের আগে বছরে কয়েকশ কোটি টাকার কাজ পাওয়া যেতো। কিন্তু করোনার কারণে অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় এবং ভার্চুয়ালি বিভিন্ন সভা-সেমিনার আয়োজিত হওয়ায় কোনও কাজ পাওয়া যায়নি। তবে প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে ছোট ছোট কিছু কাজ করতে হয়েছে। এসব কাজ দিয়ে লাভবান হওয়া যায়নি। কাজ না পেয়ে প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন ব্যবসা ছেড়েছেন। জমানো পুঁজিতে টিকে রয়েছে গুটি কয়েকে প্রতিষ্ঠান।
এদিকে কাজ না থাকায় আর্থিক সংকটের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীও ছাটাই করেছে। সেই সঙ্গে কর্মাভাবে পড়েছেন কাঠ মিস্ত্রি, ফুল ব্যবসায়ী, সাউন্ড কন্ট্রোলার, লাইট অপারেটরসহ এই খাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। চাকরি হারিয়ে কেউ হয়েছেন বেকার। কেউ বা পেশা পাল্টেছেন। আবার কেউ কেউ চলে গেছেন গ্রামের বাড়িতে।
বিয়ে-জন্মদিন থেকে শুরু করে ট্রেড-শো, কর্পোরেট বিভিন্ন অনুষ্ঠান করার দায়িত্ব পড়ে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্মগুলোর ওপর। দেশি-বিদেশি কোম্পানি, এনজিও, সরকারি পণ্য ও সেবার ব্র্যান্ডিং, প্রদর্শনী, সেমিনার ইত্যাদি আয়োজন করে এসব প্রতিষ্ঠান। বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে শুধু ঢাকাতেই গড়ে উঠেছে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ইভেন্টপ্রতি বাজেট কমছে বলে জানিয়েছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, করোনায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। এই খাতটি আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এখন কিছু কাজ পাওয়া যাচ্ছে। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ, অফিস স্পেস কমানোসহ নানান পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছেন তারা। ধীরে ধীরে আবার আগের অবস্থানে ফেরার আশা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা।
অনন্ত ইভেন্ট অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্টের স্বত্বাধিকারী আতাউর রহমান বলেন, করোনার প্রথম দিকে একেবারেই কাজ বন্ধ ছিলো। কনফারেন্স ও প্রদর্শনী এবং মেলা বন্ধ ছিলো। কিছুদিন পর ছোট পরিসরে ঘরোয়া কিছু কাজ হয়েছে। ইভেন্টগুলো হয়েছে ভার্চুয়ালি।
২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনে প্রথম যখন করোনা ধরা পড়ে, তখন থেকেই আমাদের দেশে এর প্রভাব পড়ে। ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি দেশের সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী প্লাস্টিক ফেয়ারটি হয়নি। ১৭ জানুয়ারি ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল গার্মেন্ট প্রদর্শনীটিও বন্ধ হয়ে যায়। কারণ প্রদর্শনীগুলোতে ২৪টি দেশের ফরেন ডেলিগেটদের আসার কথা ছিলো। প্রদর্শনীগুলোতে চীনের নাগরিকদেরই বেশি আসার কথা ছিলো। কিন্তু করোনার কারণে তারা আসেননি। এজন্য সেই প্রদর্শনীও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পরে চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রদর্শনীগুলো হওয়ার কথা থাকলেও করোনায় তা হয়নি। আবার আগামী বছরের জনুায়রিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। যদি এটি হয় তাহলে প্রদর্শনীগুলো আবার স্বাভাবিক হবে এবং ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট খাত আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
তিনি বলেন, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কার্পেন্টার (কাঠ মিস্ত্রি), সাউন্ড-লাইটিং কোম্পানি, পেইন্টার, প্রিন্টিং প্রেস, ফুলের কাজ করা ব্যক্তি ও লজিস্টিক কোম্পানি সংশ্লিষ্ট রয়েছে। কাজ না থাকায় তারাও এখন কর্মহীন। করোনায় প্রায় ৯০ শতাংশই কর্মহীন হয়ে পড়েছে। অনেকেই আবার মালামাল বিক্রি করে ব্যবসা পরিবর্তন করে ফেলছে।
প্রথম দিকে শতভাগ বেতন দেওয়া হলেও এক পর্যায়ে আর্থিক সংকটের কারণে ৫০ শতাংশ বেতন দেওয়া হয়। বর্তমানে আর্থিক সংকটে থাকায় লোকবল কমানো হয়েছে। বর্তমানে ৬ জন স্টাফ রয়েছে।
বিডি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের এমডি মো. মাইনুর হোসেইন (নিহাদ) বলেন, করোনার আগে প্রতি সপ্তাহে অনুষ্ঠান থাকতো। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভের পর গত বছরের মার্চ থেকে শুরু করে চলতি বছর পর্যন্ত প্রিভিয়াস ব্যাকবোনগুলো ধ্বংসের পথে। অনেক প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে আবার ট্র্যাকও পরিবর্তন করেছে। তবে বর্তমানে কাজ শুরু হয়েছে। তবে খুবই সংক্ষিপ্তভাবে হচ্ছে। আগে যেখানে ৩ হাজার লোকের আয়োজন হতো, এখন সেখানে ২শ থেকে ৩শ লোকের আয়োজন হচ্ছে। সেখানে টাকাও কম লাগছে। মানে আয়োজকরা তাদের বাজেট কমাচ্ছেন। যেসব কাজ করা হচ্ছে আসলে সেসব কাজ দিয়ে কোনোরকম প্রতিষ্ঠানের খরচটি উঠছে। কোনো লাভ হচ্ছে না। আমরা নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ কয়েক স্থানে কাজ পেয়েছি। দীর্ঘ ধকল কাটিয়ে বর্তমানে এই খাতটি আবারও স্বাভাবিক হতে শুরু করে। তবে ৬০ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গত বছরের মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কোনো কাজ পাইনি। একেবারেই জিরো ট্রানজেকশন ছিলো। নভেম্বরে গিয়ে কিছু ছোট কাজ পাওয়া গিয়েছিলো। যা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি টিকিয়ে রাখা হয়।
দেশে অনেক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম থাকলেও করোনার প্রকোপে বর্তমানে ৪০ শতাংশই বন্ধ হয়ে গেছে। আর টপ লেভেলের ৫ থেকে ৮টি প্রতিষ্ঠান প্রিভিয়াস সেভিংসের ফলে টিকে রয়েছে। আমাদের সঙ্গে ফটোগ্রাফার-ভিডিও গ্রাফারসহ নানা ধরনের লোকজন জড়িত। কাজ না থাকায় তাদের অনেকেই বর্তমানে বেকার। আমাদের প্রতিষ্ঠানে ১৬ জন স্টাফ ছিলো। কিন্তু করোনায় আর্থিক সংকটে পড়ায় লোকবল ছাটাই করে বর্তমানে ৭ জন রয়েছেন।
কুল এক্সপোজার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের সিইও ইরশাদুল হক টিংকু বলেন, কাজ শুরু হবে এমন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। এখনো পুরোদমে শুরু হয়নি। সবাই গোছাচ্ছে। অনেকেই কিছু কাজ পেয়েছে। অনেকেই কোটেশন দিয়েছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, আমরা গোছাচ্ছি। পুরোদমে কাজ শুরু হতে আরও মাস দুয়েক সময় লাগবে। অনেক প্রতিষ্ঠানের পাওনা টাকা এখনো ফেরত পাওয়া যায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, কাজ শুরু হলে আবারও পাওয়া শুরু হবে।
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড জব ইনফরমেশন নামক ফেসবুক গ্রুপটি ঘুরে দেখা গেছে, এতে ৫৭ হাজার সদস্য রয়েছে। দীর্ঘ বিরতির পর অনেকেই ব্র্যান্ড প্রমোটার, এক্সিকিউটিভ, টেকনিশিয়ান, সেলস পারসনসহ বিভিন্ন চাকরির পোস্ট দিচ্ছেন। এসব পোস্টের নিচে চাকরিপ্রার্থীরা মন্তব্যও করছেন। ফেসবুক থেকেই এসব কর্মী সোর্সিং বা জোগাড় করছেন বলে জানান ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংশ্লিষ্টরা।
বাণিজ্যিকভাবে দেশে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের যাত্রা ২০০০ সালের শুরুর দিকে। গত দুই দশকে এটা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে করোনায় বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন এ খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা।