জনপ্রিয় হয়ে উঠছে অমৌসুমে তরমুজ চাষ
মতিনুজ্জামান মিটু : তরমুজ বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় পুষ্টিকর ফল। তরমুজের মন কাড়া রং আর রসালো মিষ্টি স্বাদের জন্য সবার কাছে এফলটি প্রিয়। সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে বাজারে তরমুজ ওঠে। এটাই তরমুজের প্রধান মৌসুম।
খুলনার রুপসা উপজেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আবদুর রহমান জানান, ইদানিং দেশের বাজারে মৌসুম ছাড়াও অমৌসুমেও এ ফলটি পাওয়া যাচ্ছে। কম সময়ে, স্বল্প খরচে, অধিক ফলন ও ভালো দাম পাওয়ায় রূপসাসহ দেশের বিভিন্ন গ্রামের মাছের ঘেরের পাড়ে অমৌসুমে তরমুজ চাষ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
সরেজমিনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি আরও জানান, এ বছর রুপসা উপজেলার নতুনদিয়া, শিয়ালী, গোয়াড়া, সামন্তসেনা, পাথরঘাটা, তিলক, জাবুসা, বাধাল ও ভবানীপুর গ্রামের মাছের ঘেরের পাড়ে প্রায় ২৫ বিঘা জমিতে ইয়োলো হানি, ইয়োলো ড্রাগন, সুইট ক্রাঞ্চ, কারিশমা এসব হাইব্রিত জাতের অমৌসুমের তরমুজ চাষ হয়েছে।
সরেজমিন এসব এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মাছের ঘেরের পাড়ে সারি সারি মাচায় ঝুলে আছে হলুদ, কালো ও সবুজ ডোরাকাটা রঙের বাহারি তরমুজ। অনেক কৃষক এসব গাছের পরিচর্যা করছেন। আবার কেউ ফল তুলছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় তরমুজের বাম্পার ফলন হয়েছে এবং ব্যাপক চাহিদা থাকায় ও ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকের মুখে ফুটেছে হাসি।
রূপসা উপজেলার নতুনদিয়া গ্রামের চাষি লিটন শিকদার এবছর অমৌসুমে মৎস্য ঘেরের পাড়ে ৪ বিঘা জমিতে তৃপ্তি ও ইয়োলো ড্রাগন জাতের তরমুজ চাষ করেছেন। এতে বীজ, মাদা তৈরি, সার, মাচা তৈরি, শ্রমিক ও কীটনাশক বাবদ তার প্রায় ১১ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বীজ বপণের ৬০ দিন পর থেকে তরমুজ সংগ্রহ শুরু করা হয়। ইতিমধ্যে তিনি ২৪০ কেজি তরমুজ (প্রতি কেজি ৫০ টাকা দরে) পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। আরো প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।
একই উপজেলার সামন্তসেনা গ্রামের কৃষক সোহাগও এবছর ঘেরের পাড়ে অমৌসুমে ১ বিঘা জমিতে কারিশমা জাতের তরমুজ চাষ করেছেন। এচাষে তার খরচ হয়েছে প্রায় ৭ হাজার টাকা। তিনি এ পর্যন্ত ১১ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করেছেন। আরও প্রায় ৩ থেকে৪ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পারবেন বলে জানান। এদিকে উপজেলার জাবুসা গ্রামের চাষি আ. সালাম শেখও এবছর ঘেরের পাড়ে ২০ শতক জমিতে বর্ষা মৌসুমে তৃপ্তি নামক হাইব্রিড জাতের তরমুজ চাষ করে এ পর্যন্ত ১০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করেছেন। এতে তার খরচ হয়েছে মাত্র ৫ হাজার টাকা। ঘেরের পাড়ের এ জমি থেকে আর প্রায় ২ থেকে ৩ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।
সালাম, সোহাগ ও লিটন শিকদার ছাড়াও জাবুসা গ্রামের রবিউল ও মকছেদ, সামন্তসেনার বেল্লাল, পাথরঘাটার হরিদাস, দেব, শিয়ালী গ্রামের নিপুল ধর, সুজিত বৈরাগী, বাসুদেব, চন্দ্রকান্ত মালাকার, মনোজিৎ বিশ্বাস ও তনয় মল্লিক, নতুনদিয়ার প্রদীপ বৈরাগী, রনজিত শিকদার, উজ্জ্বল বৈরাগী, মহাদেব রায়, মন্টু অধিকারী ও গোয়াড়া গ্রামের বিবেচ্য হিরা সহ প্রায় অর্ধশতাধিক কৃষক এবছর প্রথম অমৌসুমে মৎস্য ঘেরের পাড়ে হাইব্রিড জাতের তরমুজ চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।
রূপসা উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিমাদ্রী বিশ্বাস, মো. জেহাদুল ইসলাম শেখ, নিতীশ বালা ও সোহেল রানা এসব কৃষকদের পাশে থেকে তরমুজ চাষে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে চলেছেন।
এলাকার কৃষকরা বলেন, মৎস্য ঘেরের পাড়ে অমৌসুমে তরমুজ চাষ করে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। ঘেরের পাড়ের মাটি বেশ উর্বর। চাষকৃত তরমুজ গাছ চারদিক থেকেই সূর্যের আলো পায়। এতে গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় ও ফলন ভালো হয়। সাধারণত মৎস্য ঘেরের পাড় উঁচু হয়। তাই বৃষ্টির পানি দ্রুত সরে যায়। এ কারণে বর্ষকালে ঘেরের পাড়ে খুব সহজে তরমুজ চাষ করা যায়। ঘেরের পাড়ে পানির ওপর মাচা তৈরি করে তা তরমুজ গাছের লতা বাউনির জন্য ব্যবহার করা হয়। একারণে ঘেরের পাড়ে তরমুজ চাষে জায়গা কম লাগে। আবার ঘেরে অবাধ পানি সরবরাহ থাকায় গাছে পানি সেচ দিতে সুবিধা হয়। এসময়ে তরমুজে পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ কম হয়। তাছাড়া ঘেরের পাড়ের তরমুজ গাছের পরিচর্যা করতেও সুবিধা হয় এবং অধিক ফলন পাওয়া যায়। অন্য ফসলের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি লাভ হওয়ায় মৎস্য ঘেরের পাড়ে তরমুজ চাষে ঝুঁকে পড়েছেন এখানকার কৃষকেরা। তাই প্রতি বছর রূপসা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ঘেরের পাড়ে অমৌসুমে তরমুজ চাষ বাড়ছে।
রূপসা উপজেলা কৃষি অফিসার জনাব মো. ফরিদুজ্জামান বলেন, ঘেরের পাড়ে অমৌসুমে তরমুজ চাষ হওয়ায় ভালো দাম পেয়ে কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। তাই উপজেলায় প্রতি বছর অমৌসুমে তরমুজ চাষ বাড়ছে। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে এসব কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে হাইব্রিড জাতের তরমুজ বীজ সরবরাহের পাশাপাশি উৎপাদন প্রযুক্তি সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এতে কৃষকদের মধ্যে ঘেরের পাড়ে অমৌসুমে তরমুজ চাষে ব্যাপক আগ্রহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। তারা আগামীতে মাছের ঘেরের পাড়ে আরও বেশি করে তরমুজ চাষ করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
বাংলাদেশের আবাদি জমির পরিমাণ সীমিত। কিন্তু জনসংখ্যা ক্রমশ: বাড়ছে, বাড়ছে খাদ্য চাহিদা। কিন্তু জমি বাড়ছে না; বরং কমছে। সেই সঙ্গে উর্বরা জমিতে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন মাছের ঘের। তাই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার করোনা পরবর্তী খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে এসব মৎস্য ঘেরের পাড়ে বা বেড়িতে তরমুজ ও অন্যান্য উপযোগী শস্য চাষের ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া একান্ত প্রয়োজন। এতে করোনা মহামারির কারণে কৃষি ক্ষেত্রে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনসহ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ সম্ভব হবে।