জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা ও মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় কৃষিতে নতুন প্রযুক্তি বায়োচার
মতিনুজ্জামান মিটু : জমিতে ‘বায়োচার’ বা ‘বায়োচার ইনরিচ অর্গানিক ফার্টিলাইজার’ (কার্বন সমৃদ্ধ জৈব সার) প্রয়োগই হতে পারে মাটির স্থায়ী স্বাস্থ্য রক্ষার একমাত্র উপায়।
বায়োচার এক ধরনের কয়লা যার মধ্যে ৩৫ শতাংশ থেকে ৫৫ শতাংশ কার্বন থাকে। এই কয়লা এক ধরনের চুলায় (কৃষিবন্ধুচুলা) ৩০০ থেকে ৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় স্বল্প অক্সিজেনের উপস্থিতিতে এবং পাইরোলাইসিস পদ্ধতিতে বায়োমাস পুড়িয়ে বায়োচার তৈরি করা হয়।
সিসিডিবি’র অ্যাগ্রিকালচার সিড অ্যান্ড বায়োচার প্রোগ্রামের কোঅর্ডিনেটর সমীরণ বিশ্বাস আরও জানান, বাংলাদেশে স্বাধীনতা উত্তরমাটির জৈব পদার্থ ছিল প্রায় ৪ শতাংশ। যা বর্তমানে গত ৩৯ বৎসরে ক্রমাগত কমে বর্তমানে মাটির জৈব পদাথের পরিমান ১ শতাংশ বা তারও নিচে নেমে গেছে। অর্থাৎ মাটিতে কার্বন থাকার কথা প্রায় ৩ শতাংশ। মাটির জৈব পদাথর্ কমে যাওয়ায় বর্তমানে মাটিতে কার্বন আছে মাত্র দশমিক ৫৪শতাংশের এর নীচে। যা এ দেশের আগামী কৃষিতে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
‘বায়োচার ইনরিচ অর্গানিক ফার্টিলাইজার’ বা কার্বন সমৃদ্ধ জৈব সার’ এ সার মাটিরখরা, অম্লত্ব ও লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রনকরেমটির স্থায়ী স্বাস্থ্য রক্ষা করে এবং মাটিতে অবস্থিত বিষাক্ত আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, সীসা ইত্যাদি ফসলে ঢুকতে বা আসতে দেয় না। ফলে ফসলের উৎপাদন ও গুণগত মান বাড়িয়ে কৃষকের আয় বাড়াতে সহায়তা করে। এ সার মাটিতে বসবাসকারী অনুজীবের সংখ্যা শত শত গুন বাড়িয়ে দেয় এবং মাটির পানি ধারণক্ষমতা ৫ গুন বৃদ্ধি করে। এটি রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমায় ৩৫ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ, যার ফলে উৎপাদন খরচ কমে আসে। কার্বন সমৃদ্ধ জৈব সার, ব্যবহারে বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন সহজতর হয়।
মান্দায় ও শিবালয় উপজেলায় কৃষিবন্ধুচুলার ব্যবহার দিনকেদিন বেড়েই চলেছে। এ চুলায় রান্না, পরিবেশ দূষণ রোধের পাশাপাশি উৎপাদিত বায়োচার জমিতে ব্যবহারের ফলে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা হচ্ছে। কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জমিতে একবার বায়োচার ব্যবহার করলে শ’শ বছর এর কার্যকারিতা থাকে তাই কার্বন সমৃদ্ধ বায়োচার বা কার্বন সমৃদ্ধ জৈব সার ব্যবহারে কৃষকের অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি জমির স্থায়ী উর্বরতা এবং ফলনও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মান্দা ও শিবালয় উপজেলায় প্রায় বারশতাধিক কৃষক ফুলকপি, বাধাকপি, সরিষা, গম, ধান,আলু, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, ভুট্টাসহ নানা ফসলি জমিতে কার্বন সমৃদ্ধ বায়োচার বা কার্বন সমৃদ্ধ জৈব সার প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। প্রকল্পটি আইসিসিও এবং কার্ক ইন এক্টাই এর সহায়তায় সিসিডিবি মাঠ পর্যায়ে ডি.এ.ই.কে সঙ্গে নিয়ে বাস্তবায়ন করছে।
কৃষিবিদদের উদ্ধৃতি দিয়ে বায়োচার একবার জমিতে দিলে তা শ বছর পর্যন্ত মাটিতে উপস্থিতি বজায় রাখতে সক্ষম, ফলে বাড়ে মাটির উর্বরতা। তাই রান্নার পাশাপাশি জমির গুনাগুন ধরে রাখতে বায়োচার ব্যবহরের আহ্বান জানালেন কৃষিকর্মকর্তারা।
নওগাঁ জেলার কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. শামছুল ওয়াদুদ বলেন, অধিক হারে রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটির জৈব পদার্থ কার্বন দিনদিন কমে যাচ্ছে। ক্রমাগত কমায় মাটিতে পরপর কার্বন সমৃদ্ধ জৈব সার ব্যবহারে কার্বন বাড়বে। এটির ব্যবহারে মাটিতে স্থয়ীত্বশীল স্বাস্থ্যরক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। ফলে কম রাসায়নিক সার ব্যবহার করেও কৃষকরা কাংখিত ফলাফল লাভ করবে বলেও মত প্রকাশ করেন তিনি।
ইতিমধ্যে নওগাঁর উপ-পরিচালক মো. শামছুল ওয়াদুদ এবং মানিকগঞ্জের উপ-পরিচালক মো. শাজাহান আলী বিশ্বাস প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করেন। মান্দাও শিবালয়উপজেলার কৃষিকর্মকর্তা মোছা. শায়লা শারমিন এবং রিয়াজুর রহমান বলেন, জমিতে ৫শতাংশ পর্যন্ত জৈব পদার্থ থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে কিন্তু অনেক কম পরিমাণ মাটিতে জৈব পদার্থ আছে। সেক্ষেত্রে যদি কৃষিবন্ধুচুলায় উৎপাদিত বায়োচার বা কার্বন সমৃদ্ধ জৈব সার ব্যবহার করতে পারি, এতে উপজেলাসহ বাংলাদেশের অন্যান্য উপজেলায় কৃষকেরা আশা করি উপকৃত হবে।
কৃষিবন্ধুচুলায় কাঠ বা গোবর ও বিভিন্ন ধরনের বায়োমাস বা কৃষি অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে বায়োচার পাওয়া যায়, যা কার্বন সমৃদ্ধ। এই কার্বন সমৃদ্ধ বায়োচার জমিতে ব্যবহারে জমির উর্বরতা বাড়ে এবং খরাপ্রবণ এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চাষাবাদ করা যায়। বায়োচার জমিতে ভারী ও বিষাক্ত ধাতুকে (হেভী মেটালকে) নিস্ক্রিয় করে রাখে। ফলে উদ্ভিদের শিকড়ের সাহায্যে তা ফসল পর্যন্ত পৌঁছায়না । ফলে পাওয়া যায় নিরাপদ ও বিষাক্ত ধাতু মুক্ত ফসল। এই চুলায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ জ্বালানি কম লাগে। তাই বনজ সম্পদ রক্ষাপায় ও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে, খাদ্য নিরাপত্তায় এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে মত প্রকাশ করেন সশ্লিষ্ট কমর্কর্তারা।