ধর্মবোধ আর শুভ সুন্দর সমাজ-সংস্কৃতি চেতনার মিলন
ডা. সুব্রত ঘোষ
বাঙালি সমাজে দুর্গাপূজার ব্যাপক প্রসারের পেছনে ধর্মতত্ত্বের প্রভাবটাই বড়, নাকি অর্থনীতি-সংস্কৃতি-লোকাচারের, সেটাও ভেবে দেখার বিষয় বটে। আসলে যেকোনো ধর্মানুষ্ঠানেরই মর্মমূলে ধর্মতত্ত্বের বীজটা থাকলেও উৎসবের মাঠজুড়ে থাকে সমাজ-সংস্কৃতির ফসল। কালের প্রভাবে সংঘটিত অন্তরঙ্গের পরিবর্তনটা সচেতন মনোযোগ না পেলেও বহিরঙ্গের বিবর্তনটা নজর এড়ায় না। শাস্ত্রজ্ঞানীদের অভিমত, অতি প্রাচীনকালে ঋষিগণ ধ্যানের সময় আগুন জ্বালিয়ে যজ্ঞ না করলেও দশদিক বা দশ বাহুবিশিষ্ট যজ্ঞবেদী বা কু- প্রস্তুত এবং রক্ষা করতেন। পরবর্তী সময়ে আগুন জ্বালিয়ে যজ্ঞ করার সূত্রপাত ঘটলে যজ্ঞস্থলে আগুনের প্রতীক হিসেবে ‘হব্যবাহনী’ বা ‘দক্ষকন্যা’ মূর্তি স্থাপন করা হতো। যজ্ঞকু-ের দশদিক হলো দেবীর দশ বাহুÑ এভাবেই দুর্গামূর্তির উদ্ভব হয়েছিল। প্রাচীন ঋষিগণ দশ বাহুবিশিষ্ট যজ্ঞস্থলি নির্মাণ করতেন কেন? এমন প্রশ্নে আমরা নিজের মতো করেই ভাবতে পারি, বিশ্ব প্রতীক রূপেই যজ্ঞ ম-লের চিন্তা করা হয়েছিল এবং বিশ্বের দশ দিকের প্রতীক হিসেবেই যজ্ঞস্থলিকে দশ বাহুবিশিষ্ট করা হতো। যজ্ঞস্থলিতে কল্পিত আরাধ্যকেই ভাবা হয়েছে জগদীশ্বরÑ পুরুষরূপে যিনি জগৎ পিতা এবং নারীরূপে তিনিই জগজ্জননী। প্রাচীন যুগের ঋষি চিন্তায় ঈশ্বরের পুরুষসত্তা আরাধ্য হলো শিবরূপে আর নারীসত্তা শক্তিরূপে। ‘এলেম আমি কোথা থেকে’Ñ সৃষ্টিতত্ত্বের অন্বেষণটাই ধর্মতত্ত্বের গোড়ার কথা আর এ অন্বেষণ কর্মটাকেই যদি সাধনা বলি, তাহলেই বলা যায়, এমন অন্বেষণ পথেই স্রষ্টার তথা শিব শক্তির উপলব্ধি এসেছিল ঋষি হৃদয়ে। দশদিক থেকে সুরক্ষা প্রত্যাশী ঋষিগণ বিশ্ব প্রতীক যজ্ঞস্থলির দশ বাহুকেই শক্তি স্বরূপা জগজ্জননীর দশ বাহু হিসেবে কল্পনা করেছেন।
শাস্ত্রজ্ঞানীর বক্তব্য মানলেও প্রশ্ন জাগে, দুর্গামূর্তির কল্পনা বা দুর্গাপূজার শুরু কতকাল আগে? রামায়ণে উল্লিখিত আছে, সীতা উদ্ধারের জন্য লঙ্কার ‘রাক্ষস-রাজা দশানন রাবণ’-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত শ্রীরামচন্দ্রই প্রথম দুর্গাপূজা করেছিলেন, প্রচলিত বিশ্বাস, এর আগে বসন্তকালে ‘বাসন্তী পূজা’ নামে দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল। অনেকের বিশ্বাস, রামায়ণে বর্ণিত ‘রাজা সুরথ’ই প্রথম দুর্গা প্রতিমা তৈরি করে বসন্তকালে পূজার প্রবর্তন করেছিলেন। আবার রামায়ণ সূত্রেই অনেকে এমন বিশ্বাসও করেন যে, লঙ্কার রাজা রাবণ নিজেও বাসন্তী পূজা করতেন। খ্রিস্টপূর্ব ২য় বা ৩য় শতকে, বাল্মীকি-রামায়ণ রচিত হয়েছিল।
ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন জানিয়েছেন, ‘সবচেয়ে প্রাচীন যে মহিষমর্দিনীর মূর্তিটি পাওয়া গেছে তা পঞ্চম শতাব্দীর’। অর্থাৎ মোটামুটি পনের বা ষোল’শ বছর আগে দুর্গাপূজার, কিংবা অন্ততপক্ষে প্রতিমা-কল্পনার সূচনা হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা চলে। কিন্তু সে সময়ে দুর্গাপূজার বহুল প্রচলনের কোনো তথ্য জানা যায় না এবং বাংলার বাইরে, বিশেষত বাঙালি সমাজের বাইরে দুর্গাপূজার এমন জনপ্রিয়তারও নজির নেই। প্রশ্ন জাগতেই পারে, কিন্তু নির্ভরযোগ্য উত্তর মেলে না, সুদূর সিংহলে যে পূজার সূত্রপাত করেছিলেন অযোধ্যার (মধ্যভারত) রাজা শ্রীরামচন্দ্র, অন্য কোথাও নয়, এত দূরের বাংলায় এসে সেই পূজা এমন বিপুল জনপ্রিয় হয়ে উঠল কেন? রামায়ণের শ্রীরামচন্দ্রই প্রথম শরৎকালে দুর্গাপূজা করেছিলেন, তৎপূর্বে বাসন্তীপূজা প্রচলিত ছিল, প্রতিমা কল্পনায় বাসন্তী-দুর্গা এবং শারদীয় দুর্গা অভিন্ন ইত্যাদি তথ্যও কয়েকটি প্রশ্ন জাগায়। প্রায় আড়াই হাজার বছর বা বেশি আগে, অর্থাৎ রামায়ণের পূর্ববর্তী বা অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে মহিষমর্দিনী দুর্গার পূজা প্রচলিত থাকলে ততটা প্রাচীন কোনো প্রতিমার সন্ধান পাওয়া যায়নি কেন? শ্রীরামচন্দ্রই যদি দুর্গাপূজার প্রবর্তক হয়ে থাকেন, তাহলে তারপর থেকেই কি দুর্গাপূজার ধারাবাহিকতা চলে আসছে? শাস্ত্র সূত্রে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জটিল পথে না গিয়ে আমরা ইতিহাসের পথে হাঁটতে পারি। এ কথাই ঐতিহাসিক সত্য যে, বাংলাদেশে দুর্গাপূজার প্রচলন-প্রসার আদৌ কোনো সুপ্রাচীন ব্যাপার নয়। মোগল সম্রাট আকবরের (১৫৪২-১৬০৫ খ্রি.) সময় রাজশাহীর তাহিরপুরে দেওয়ান, রাজা কংস নারায়ণই এ দেশে প্রথম দুর্গাপূজা করেছিলেন বলে জানা যায়। অর্থাৎ বাংলাদেশে বা বাঙালি সমাজে দুর্গাপূজার প্রবর্তন প্রসারের ইতিহাস মোটামুটি শ’পাঁচেক বছরের মাত্র।
কবি কৃত্তিবাস ওঝা, বাংলা-রামায়ণের স্রষ্টা, জন্ম বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায়, শিক্ষা এবং কর্মজীবনের প্রথম দিকটা কাটিয়েছেন যথাক্রমে বর্তমান বাংলাদেশের বরেন্দ্র এলাকায় এবং তৎসন্নিহিত গৌড় রাজ্যে। সেটা ১৭শ শতকের, অর্থাৎ তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণের দুর্গাপূজা প্রবর্তনের পরবর্তী সময়ের ঘটনা। যুক্তিসঙ্গত কারণেই ধারণা করা চলে, ততদিনে শতাধিক বছরের মধ্যে কংসনারায়ণ প্রবর্তিত এবং স্থানীয়ভাবে কিছুটা হলেও জনপ্রিয়তা পাওয়া শক্তিরূপিনী দুর্গাপূজার ধর্মীয় মাহাত্ম্য এবং রাজসিকতার বিষয়গুলো কৃত্তিবাসের কবিচিত্তকে স্বাভাবিকভাবেই প্রভাবিত করেছিল। তার রচিত রামায়ণ সম্পর্কে বাংলাদেশ শিশু একাডেমিকর্তৃক প্রকাশিত শিশু বিশ্বকোষে বলা হয়েছে, তিনি যে ‘রামায়ণ’ রচনা করেন তাকে অনেকেই বাল্মীকির ‘রামায়ণ’-এর অনুবাদ বলতে নারাজ। আসলে লোকমুখে প্রচলিত বাল্মীকি রচিত রামায়ণের ধারাটিকে কৃত্তিবাস নিজের মতো করে বর্ণনা করেছেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণেই শ্রীরামচন্দ্রের ‘অকাল বোধন’ দুর্গাপূজার কথা, শত্রু-জয়ে শক্তিরূপিনী দশভুজা দুর্গার মাহাত্ম্য-কথা বর্ণিত হয়েছে।’
আমাদের দুর্গোৎসবের চেতনায়-অনুভবে ধর্মাচারে-লোকাচারে এমন গভীরভাবেই মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে যে, ভেদ-রেখাটির অনুসন্ধান নিতাস্তই হবে প-শ্রম। এ কথাই সত্য যে, মায়েতে-মেয়েতে মিলেমিশে দুর্গা প্রতিমা আর পূজা প্রকরণে এবং অবশ্যই উৎসবেও বাঙালি-জীবনেরই প্রতিফলন ঘটেছে, কখনো প্রাত্যহিকতার, কখনো বা প্রত্যাশার।
লেখক: কলামিস্ট, চিকিৎসক, সমাজকর্মী এবং সংগঠক
সম্পাদনা: আশিক রহমান