বাংলা নামের নকশীকাঁথায় শেখ রাসেল
ড. আতিউর রহমান
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকা- নিঃসন্দেহে ইতিহাসের সবচেয়ে অমানবিক একটি ঘটনা। এ আক্রমণে আমরা শুধু জাতির পিতাকে শারীরিকভাবে হারাইনি, আমরা স্বপ্নের বাংলাদেশকেও হারিয়েছিলাম। সবচেয়ে বড় কথা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর পরিবারের সদস্য যারা বাংলাদেশে ছিলেন তাদের প্রায় সবাইকে নিশ্চিহ্ন করা হয়। তাঁর দুই কন্যা দেশের বাইরে ছিলেন বলে তারা রক্ষা পেয়েছেন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি হৃদয়বিদারক হলো শিশু রাসেলকে হত্যা করা। শিশু হত্যা যে মহাপাপ ঘাতক ও নরপিশাচরা সেটা মনে রাখেনি। একটি শিশুর আকুতিকে যেভাবে তারা উপেক্ষা করেছে তাতে আমাদের যে জাতীয় মূল্যবোধ, বাঙালির যে মানবিক পরিচয়, সবকিছু ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছিলো। এই শিশু জানতো ও না কী কারণে তাকে হত্যা করা হচ্ছে। সে তার মায়ের কাছে যেতে চেয়েছে। মায়ের কাছে নিয়ে যাবে বলে কথা দিয়েও নরপিশাচরা তাকে হত্যা করেছে। এই জঘন্য হত্যাকা- ইতিহাসে বিরল। পুরো তরুণ সমাজের জানা উচিত, এটি ছিলো আমাদের বাংলাদেশ নামের ইতিহাস, সংস্কৃতি, পারিবারিক বন্ধন এবং ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার এক ষড়যন্ত্র।
যে কারণে ১৫ আগস্টের হত্যাকা-ের পর বাংলাদেশ হারিয়েছিলো তার মানবিক পরিচয়, সামজিক ঐতিহ্যের গর্ব এবং শিশুদের প্রতি বাঙালির দীর্ঘদিনের যে ¯েœহপরশ। এই সবকিছু থেকে বাঙালিকে বঞ্চিত করেছিলো এই হত্যাকা-। সারা পৃথিবীতে আমাদের পরিচয় হয়েছিলো হত্যাকারীর দেশ। দীর্ঘ সময় লেগেছে এই উল্টোপথে যাত্রার বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনতে। বঙ্গবন্ধু কন্যার হাত ধরেই আবার ফিরে এসেছে মানবিকতা ও শিশুর প্রতি শুভ আচরণের বাংলাদেশে।
শেখ রাসেলের নামে বঙ্গবন্ধুকন্যা ভীষণভাবে আবেগাপ্লুত হয়ে যান। শিশুদের জন্য অনেক কিছু করার উদ্যোগ নিয়েছেন। শিশু একাডেমিসহ শিশুদের উন্নয়নের জন্য তিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সকল কিছুতেই জোর দেন। কারণ তার হৃদয়ে এই ভাইটির স্মৃতি সবসময়ই ভেসে ওঠে। আমাদের নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য শিশু রাসেলের জন্মদিনে আমাদের ১৫ আগস্টের সেই বিভীষিকাময় সময়কে আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। অমানুষদের কী অন্যায় আক্রমণের শিকার হয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। সমাজে আর যেন কোনোদিন এ রকম ঘটনা না ঘটে। সমাজে যেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিসহ শান্তি বিরাজ করে সেটিই আমাদের কাম্য। কারণ সামাজিক শান্তি থাকলেই দেশের উন্নয়ন ঘটানো যায়। মানুষের মধ্যে আশাবাদ তৈরি করা যায়। সুতরাং শেখ রাসেলের এবারের জন্মদিনে নতুন করে আমাদের একটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
দেশের সমাজিক শান্তি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার একটা হীনপ্রচেষ্টা চলছে। আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই বাংলাদেশে সব মানুষের। এই বাংলাদেশের মানুষের শরীরে একই রঙের রক্ত বইছে। আমরা একই সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। এটি বহিমাত্রিক সংস্কৃতি এবং বাংলা নামের নকশী কাঁথায় আমরা নানা ধরনের রং দেখতে পাই বলেই বাঙালি সংস্কৃতি এতোটা গর্বের আমাদের কাছে। সুতরাং এই বাংলাদেশে শিশুহত্যা হবে, এটা আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। আমাদের সবসময় শিশুদের প্রতি আরও সচেতন ও যতœ নেওয়া উচিত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশু রাসেলের কথা সবসময় মাথায় রাখেন এবং শিশুদের জন্য কোনো কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। শিশু রাসেলের কথা সবসময় তার মনে পড়ে এবং মনে পড়ে বলে দেশের শিশুদের প্রতি বিশেষ নজর দেন। বঙ্গবন্ধুও শিশুদের সঙ্গে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। সেজন্যই বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে শিশু দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু ও শেখ রাসেলের কথা মাথায় রেখেই বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটিকে জাতীয় শিশু দিবস ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। আমরা দেখতে পাই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে শেখ রাসেলকে নিয়ে কতো মধুর স্মৃতি। আমাদের নতুন প্রজন্ম যখন বঙ্গবন্ধুর লেখা বইগুলো পড়বেন, নিশ্চয়ই শেখ রাসেল সম্পর্কে তারা জানবেন এবং তাকে তারা মনে রাখবেন।
পরিচিতি : বঙ্গবন্ধু গবেষক ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমিরুল ইসলাম