লক্ষ্যহীনভাবে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস!
ডা. জাকির হোসেন
জননন্দিত দৈনিক পত্রিকা আমাদের অর্থনীতিতে কলাম লিখে পরিচিতি পেলেও আমার চিকিৎসা পেশার জায়গাটিতে দিনের বেশির ভাগ সময় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হয়। শত হলেও সেবামূলক পেশা। পক্ষান্তরে লেখালেখি কিন্তু কম সেবামূলক পেশা নয়। ঘুমন্ত সমাজকে জাগিয়ে তোলার এক উত্তম নিয়ামক হলো লেখালেখি। এখন মূল লেখায় আসিÑ ছন্দা ছদ্মনাম, আমার পরিচিত এক ধনাঢ্য গৃহিণীর নাম। বয়স আনুমানিক ৪০-এর কোটায়। দুই পুত্র সন্তানের জননী। স্বামী পেশায় ব্যবসায়ী। আমার কাছে প্রায়ই তার দুই ছেলের চিকিৎসার জন্য আসেন। একদিন উনি তার মোটিয়ে যাওয়া রোধ করার জন্য আমার কাছে ব্যবস্থাপত্র চাইলেন। আমি মেপে দেখলাম তার ওজন প্রায় ৬৫ কেজি। তাকে দৈনিক খাবারের একটি খাদ্য তালিকা তৈরি করে দিলাম, এর ঠিক সপ্তাহ দুই পরে উনি ঠিক বেহুশের মতো হয়ে আমার কাছে আসলেন। তার এই ইমার্জেন্সি অবস্থা খুব ভালোভাবেই ম্যানেজ করলাম। তার ঠিক দুদিন পর উনি আবারও আসলেন এবং আমার কাছে ক্ষমা চাইলেন। জিজ্ঞেস করলাম, কেন ক্ষমা চাইছেন? কি হয়েছে? উত্তরে উনি বললেন, আপনাকে আমি একটি সত্য কথা বলিনি। জিজ্ঞেস করলাম, কি কথা? উনি বললেন, আমি ওইদিন দুইটা ইয়াবা ট্যাবলেট খেয়ে বেহুশ হয়ে আপনার কাছে এসেছিলাম। জানতে চাইলাম, কেন খেয়েছিলেন? বললেন, উনার এক বান্ধবী বলেছে এই ট্যাবলেট খেলে শরীরের ওজন কমে যায়, সেজন্যই খেয়েছি। তার কথা শুনে বেশ মর্মাহত হলাম।
গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, পেথিডিন ইত্যাদির হাত ধরে দেশে এখন ইয়াবা সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সহজলভ্য মাদক। তাকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করাতে পারলাম না এই ট্যাবলেট ওজন কমানোর জন্য নয়, এটা এক ধরনের নেশা জাতীয় ট্যাবলেট। আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে কয়েক বছরে দেশে অনেক বেশি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সমাজে বিভিন্ন কারণে বাড়ছে অস্থিরতা আর এই অস্থিরতার রাহুগ্রাস থেকে নিস্তার পাচ্ছে না সমাজের তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে আবাল বৃদ্ধ-বণিতা কেউ-ই। এই অস্থিরতার সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে তরুণ সমাজের ওপর।
বদলে যাচ্ছে তরুণদের মুখের ভাষা। স্মার্টনেসের নামে যোগ হচ্ছে, শব্দের অপ্রয়োজনীয় প্রয়োগ, সামাজিক নিয়ম ভাঙার প্রবণতা, বিনা কারণে রাত জাগার প্রবণতা, নিজের ঘরে একা নিজেকে আবদ্ধ করে রাখার প্রবণতা, খুব দ্রুত বন্ধুত্ব করা, ততধিক দ্রুতই আবার বন্ধুত্ব ভেঙে ফেলা, মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন। একসময় বন্ধন থেকে বহুদূরে তাদের অবস্থান এবং নেশার জগতের সঙ্গে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। সঙ্গে সঙ্গে মাদকের সহজলভ্যতা আর মূল্যবোধের মারাত্মক অবক্ষয়ের কারণে দিনে দিনে বেড়েই চলছে এর ব্যাপকতা।
১৯৮৮ সাল থেকে প্রতিবছর ২৬ জুনকে আন্তর্জাতিক মাদক বিরোধী দিবস হিসেবে পালন করে আসছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো। একথা তো বলাই যায়Ñ একরকম লক্ষ্যহীনভাবে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাদক বিরোধী দিবস! ১৯৮৮-২০১৬ এই দীর্ঘসময়ে বিশ্বজুড়ে কমেনি এর ব্যাপকতা, বরং দিন দিন যেন আরও বেড়েই চলছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়। কিন্তু কোনোভাবেই যেন দেশ এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। মাদকের কাছে যেন অসহায় হয়ে পড়ছেÑ পরিবার, সমাজব্যবস্থা এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থাও। আক্রান্ত রোগীর যে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা প্রয়োজন তা দিতে গিয়ে চিকিৎসকেরা যেমন হিমশিম খাচ্ছেন, একইসঙ্গে আক্রান্ত পরিবারটিও অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার রোধে বিশ্বের সকল রাষ্ট্র একসঙ্গে, একনীতি নিয়ে কাজ করলেই কেবল এই দুর্যোগ থেকে মানুষের পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
লেখক : চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন