দুই বছরের মধ্যে একদিনে সূচকের সর্বোচ্চ পতন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে ঘিরে পুঁজিবাজারে সক্রিয় কারসাজিকারিরা
মাসুদ মিয়া : দেশের শেয়ারবাজার আগের কার্যদিবসের ধারাবাহিকতায় ব্যাপক দরপতনের মধ্যে দিয়ে সোমবার লেনদেন শেষ হয়েছে। এদিন প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ডিএসইর প্রধান সূচক পৌনে ৩ শতাংশ বা ১৮২ পয়েন্ট কমে নেমে এসেছে সাড়ে ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে।
যা গত দুই বছরের মধ্যে একদিনে সূচকের সর্বোচ্চ দরপতন হয়েছে। এর আগে ২০২০ সালের ১৬ মার্চ সূচকটি ১৯৬ পয়েন্ট কমেছিল। এরপর গত দুই বছরে দেশের শেয়ারবাজারে আর এতো বড় দরপতন দেখা যায়নি।
বড় এ পতনে ডিএসইএক্স সূচকটি সাড়ে ছয় হাজারের সীমার নিচে নেমে যাওয়ায় আতঙ্কিত বিনিয়োগকারীরা আরও বেশি শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
গতকাল দরপতন এতটাই ভয়াবহ ছিল যে দিন শেষে লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে মাত্র সাতটির দাম বেড়েছে। আর দাম কমেছে ৩৬৪টির বা ৯৬ শতাংশের দাম। এবিষয়ে বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, অনেকদিন ধরেই শেয়ারবাজার নি¤œমুখী ধারায় রয়েছে। এর মধ্যে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামারিক অভিযান শুরু হলো। আসলে আমাদের বিনিয়োগকারীরা হুজুগে বিনিয়োগ করেন। এ যুদ্ধের কোনো প্রভাব আমাদের দেশে পড়ার কথা নয়।
সংশ্লিষ্টরা আরও বলেন, রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের যুদ্ধের কিছু প্রভাব বিশ্বে পড়লেও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এর থেকে নিরাপদে আছে। আশা করা যাচ্ছে যুদ্ধ দীর্ঘ মেয়াদী হবে না।
এবিষয়ে বিনিয়োগকারী জামান বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে পুঁজি করে কারসাজি চক্র সক্রিয় হয়েছে। যার কারনে শেয়ারবাজারে বড় বড় দরপতন হচ্ছে। এভাবে বাজারকে ফেলে দিয়েছে। এটা কোনো স্বাভাবিক পতন হতে পারে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অবশ্যই পতনের কারণ খুঁজতে হবে। একই সাথে এর সাথে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। জামান আরও বলেন, শেয়ারবাজারে প্রতি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা অভাব দেখা যাচ্ছে। একারনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। পতনের কারনে আমাদের মতো সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হচ্ছে। জামান বলেন, আমাদেরে দেশের অর্থনীতি অবস্থায় খুবই ভালো তারপর কেন শেয়ারবাজারে দরপতন হচ্ছে এটাও শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে খুজে বের করতে হবে।
এবিষয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুল রাজ্জাক বলেন, রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের যুদ্ধের কিছু প্রভাব বিশ্বে পড়লেও বাংলাদেশ শেয়ারবাজারে প্রভাব পড়ার কথা না। আশা করী যুদ্ধ দীর্ঘ মেয়াদী হবে না। রাজ্জাক বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে পুঁজি করে কারসাজিকারিরা সুবিধা নেয়ার আশায় এভাবে বাজারকে ফেলে দিয়েছে। এটা কোনো স্বাভাবিক পতন হতে পারে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অবশ্যই পতনের কারণ খুঁজতে হবে। একই সাথে এর সাথে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান। গতকাল লেনদেন শুরু হতেই দরপতনের তালিকায় নাম লেখাতে থাকে একের পর এক প্রতিষ্ঠান, যা অব্যাহত থাকে লেনদেনের শেষ পর্যন্ত। ফলে দিনের লেনদেন শেষে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) মাত্র সাতটি প্রতিষ্ঠান দাম বাড়ার তালিকায় স্থান করে নিতে পেরেছে। বিপরীতে দাম কমেছে ৩৬৪টির।
৮টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রায় সবকটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমার ফলে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ১৮২ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ৪৫৬ পয়েন্টে নেমে গেছে। এর আগে ২০২০ সালের ১৬ মার্চ সূচকটি ১৯৬ পয়েন্ট কমেছিল। এরপর গত দুই বছরে দেশের শেয়ারবাজারে আর এতো বড় দরপতন দেখা যায়নি। ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচকের পাশাপাশি বড় পতন হয়েছে অন্য দুই সূচকের। এর মধ্যে বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক আগের দিনের তুলনায় ৬৪ পয়েন্ট কমে ২ হাজার ৩৭৪ পয়েন্টে নেমে গেছে। ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক ৩৬ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৩৯৬ পয়েন্টে অবস্থান করছে।
গত বছরের অক্টোবর থেকেই দেশের শেয়ারবাজারে নেতিবাচক ধারা বিরাজ করলেও সম্প্রতি ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান শুরুর পর দরপতনের মাত্রা অত্যধিক বেড়ে যায়। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান শুরুর পরে দেশের শেয়ারবাজারে এ পর্যন্ত আট কার্যদিবস লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে সাত কার্যদিবসেই দরপতনে পার করেছে শেয়ারবাজার। এতে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক কমেছে ৪৯২ পয়েন্ট।
এদিকে সূচকের টানা পতনের সঙ্গে লেনদেন খরাও দেখা দিয়েছে শেয়ারবাজারে। সোমবার দিনভর ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৭৪০ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এর মাধ্যমে টানা সাত কার্যদিবস ডিএসইতে হাজার কোটি টাকার কম লেনদেন হলো। গতকাল ডিএসইর দিনভর সূচক পতনের মধ্য দিয়ে লেনদেন হয়েছে। এদিন ডিএসইতে ৩৭৯টি প্রতিষ্ঠানের ২০ কোটি ৬৮ লাখ ১৫ হাজার ৯৭৯টি শেয়ার ও ইউনিট কেনাবেচা হয়েছে। এর মধ্যে ৭টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে, কমেছে ৩৬৪টির, অপরিবর্তিত রয়েছে আটটির দাম।
তাতে ডিএসইর প্রধান সূচক ১৮২ দশমিক ১২ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ৪৫৬ পয়েন্টে অবস্থান করছে। অর্থাৎ সূচক সাড়ে ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে চলে এসেছে। এদিন ডিএসইর অপর দুই সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের চেয়ে কমেছে ৩৬ দশমিক ৬১ পয়েন্ট এবং ডিএস-৩০ সূচক কমেছে ৬৪ পয়েন্ট।
এদিন সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ার। এরপর ছিল বিএসসি, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো, ওরিয়ন ফার্মা, ফরচুন সুজ, লাফার্জহোলসিম, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, সাইফ পাওয়ার, স্কয়ার ফার্মা এবং ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড।
অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৪৫৫ দশমিক ৩৬ পয়েন্ট কমে ১৮ হাজার ৯৮৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। সিএসইতে ২৯৪টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বেড়েছে, কমেছে ২৫৪, অপরিবর্তিত রয়েছে ২১টির দাম।
এ বাজারে লেনদেন হয়েছে ২০ কোটি ৭১ লাখ ৬৮ হাজার ৮৩১ টাকার শেয়ার। এর আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১৭ কোটি ৮১ লাখ ৩১ হাজার ৯১৯ টাকার শেয়ার।