হারিয়ে যাচ্ছে অনেক জীববৈচিত্র্য ও স্বাদু পানির উৎস
মতিনুজ্জামান মিটু : পানি সম্পদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশেষ করে কৃষি উৎপাদন ও সেচের ওপর চাপ বেড়েছে। রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং সম্ভাবনা ও করণীয় প্রসঙ্গে এফএও এবং ইউনাইটেড স্টাটিস জিয়োলজিক্যাল সার্ভে(ইউএসজিএস)সহ বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সুত্রের বরাতে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) এর সদস্য পরিচালক (ক্ষুদ্র সেচ) মো. জিয়াউল হক জানান, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবীতে সুপেয় পানির ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। বিশ্বের মোট ৭৮৭ কোটি ৫০ লাখ জন সংখ্যার ৪০শতাংশ চাহিদার চেয়ে কম পানি পাচ্ছেন। তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ছে।
পৃথিবীর দুই ভাগ(২৯শতাংশ) স্থল এবং বাকি পাঁচ ভাগ (৭১শতাংশ) জল। বিশ্বে মোট পানিসম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৪০০ মিলিয়ন কিউবিক কিলোমিটার (মিসিকেএম)। এরমধ্যে সুপেয় বা মিঠা বা স্বাদু পানি ২.৫শতাংশ এবং অপেয় বা লবণ পানি ৯৭.৫শতাংশ। অবস্থানগত দিক হতে সুপেয় পানি ভূগর্ভে-৩০.৮শতাংশ, ভূ-উপরে ০.৩শতাংশ ও বরফ ও অন্যান্য ৬৮.৯শতাংশ। বাংলাদেশে মোট পানি সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৪০৪ বিলিয়ন কিউবিক মিটার (বিসিএম)। এরমধ্যে ভূগর্ভে প্রায় ৫৪.০৪ বিসিএম ও ভূউপরে প্রায় ১৩৫০ বিসিএম। ওই ভূপরিস্থ পানি নদ-নদীতে ১০১০ বিসিএম ও বার্ষিক বৃষ্টিপাত হতে ৩৪০ বিসিএম কৃষি খাতে (কৃষি, পশু ও মৎস্য) ৮৭শতংশ, গৃহস্থালিতে ১০শতাংশ ও শিল্পে ৩শতাংশ পানি ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশে মৌসুমি জলবায়ু বিরাজমান। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে জীবকুল ও পরিবেশের ওপর।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা। গলে যাচ্ছে হাজার বছরের হিমবাহ। বাড়ছে সমুদ্রের পানির উচ্চতা এবং উপকূলীয় এলাকায় ভূগর্ভে ও ভূ-ওপরে লবণ পানির অনুপ্রবেশ ঘটছে। হারিয়ে যাচ্ছে অনেক জীববৈচিত্র্য ও স্বাদু পানির উৎস। ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও অন্যান্য চাহিদা মিটাতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বাড়ছে। একারণে ভূগর্ভস্থ বেশি পানি উত্তোলনের ফলে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বাড়ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ৩০ ভাগ উপকুলীয় এলাকার ১৭ শতাংশে লবণাক্ততা বিস্তৃত হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশসহ বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ এবং পানি সংকট নিয়ন্ত্রণ একটি ক্রমবর্ধমান কঠিন সমস্যা হয়ে উঠেছে। ইংরেজি রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং বাক্যটির সঙ্গে সবাই কমবেশি পরিচিত। বাংলায় যা বৃষ্টির পানি সংগ্রহকে বুঝায়। রেইনওয়াটার সুপেয় ও নিরাপদ পানি।
স্বাদু ও নিরাপদ পানির উৎস বৃষ্টিপাত। বাংলাদেশের গড় বৃষ্টিপাত ২০৩০ মিলিমিটার (মিমি) এবং গড় তাপমাত্রা ২৫.৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ অসম তাপমাত্রার কারণেই অসম ও অনিশ্চিত বৃষ্টিপাত হয়। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত বিশ্লেষণে জানা যায়; ৮২শতাংশ বৃষ্টিপাত মে থেকে সেপ্টেম্বরে (জ্যৈষ্ঠ থেকে আশ্বিন) হয়। ওয়াটার এইড বাংলাদেশের এক সমীক্ষার হিসেবে শহরের সচ্ছল পরিবার গোসলে ৪১শতাংশ পানি, কমোড ফ্ল্যাশ ও কাপড়চোপড় পরিষ্কারে ২২শতাংশ এবং বাকি পানি রান্নাবান্নাসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হয়। ঢাকা ওয়াসার এক পরিসংখ্যান মতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে পারিবারিক মোট চাহিদার প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মেটানো সম্ভব। সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্যহীনতা, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং ঘনবসতিপূর্ণ জনসংখার বাড়ানোর মতো চলমান সমস্যাগুলো মেটাতে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ একটি পুনঃব্যবহারপদ্ধতি।
মো. জিয়াউল হক আরও জানান, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) প্রাথমিক পর্যায়ে দেশের দুর্গম উপকূলীয় লবণাক্ত (ভূগর্ভে ও ভূউপর) এলাকায় ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষক বা নৃ-গোষ্ঠী যাদের বাড়িতে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাবার পানির কোন সুযোগ (নলকূপ) নেই, সেসব এলাকায় নির্দিষ্ট আকার ও ডিজাইনের বৃষ্টির পানি সংগ্রহ অবকাঠামো নির্মাণ করে থাকে। এ ছাড়াও কৃষকের দো বা চার চালা টিনের ঘরে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের সরঞ্জামাদি সংযোজনের মাধ্যমে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। উপকূলীয় দুর্গম এলাকার হতদরিদ্র মানুষগুলো সবসময় দৃষ্টি সীমার বাহিরে থাকে। তাদের পক্ষে নলকূপ স্থাপন করে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি পান করা সম্ভব হয় না। তাই স্থানীয়ভাবে পুকুর ও ডোবার পানি পান করার ফলে পানিবাহিত রোগ দেখা দেয়।
অপর দিকে, অনেক জায়গায় ভূগর্ভে মিঠা বা স্বাদু পানি পাওয়া যায় না। তাই উপজেলা সেচ কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ অবকাঠামো বাস্তবায়ন করা হয়। ইতিমধ্যে বিএডিসির মাধ্যমে বাস্তবায়িত বৈদেশিক(বিশ্ব ব্যাংক) সাহায্যপুষ্ট সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প (আইএপিপি) এর আওতায় এলাকায় মোট ১৬০২টি ও চলমান বৈদেশিক(্ইফাদ) সাহায্যপুষ্ট স্মলহোল্ডার্স এগ্রিকালচারাল কম্পিটিটিভনেস প্রজেক্ট (এসএসিপি) এর আওতায় মোট ৫০২টি অর্থাৎ সর্বমোট ২১০৪টি অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ করেছে। এতে দুর্গম উপকূলীয় এলাকার হাজার হাজার মানুষের পানীয় জলের সমস্যা দূরীভূত করা সম্ভব হয়েছে। পৃথিবীর পানিসম্পদের মধ্যে বৃষ্টির পানি সবচেয়ে বিশুদ্ধ, নিরাপদ এবং বিপদমুক্ত। এপানিতে রাসায়নিক পদার্থ ও লবণ নেই, আছে ভিটামিন। বাংলাদেশে মৌসুমি জলবায়ুর কারণে প্রায় পাঁচ মাসের বেশিসময় সারাদেশে বৃষ্টি হয়ে থাকে।