আড়াই মাসে খাদ্য মজুত কমেছে ৯ লাখ টন
মো. আখতারুজ্জামান : দেশে অতি দরিদ্রদের জন্য সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কার্যক্রম ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং (ভিজিএফ) এবং সারাদেশে খোলাবাজারে খাদ্যপণ্য বিক্রি বা ওএমএস কার্যক্রম পুরোদমে চলায় সরকারি গুদামগুলোতে খাদ্যশস্যের মজুত কমে আসছে।
আড়াই মাসের ব্যবধানে ৯ লাখ টন কমে খাদ্যের মজুত দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ২৮ হাজার টনে। তবে রোবো মৌসুমের ধান সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করা হয়েছে তা যথাযথভাবে হলে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকি কমবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। সেইসঙ্গে অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য ভারত, রাশিয়া ও ইউক্রেনের বাহিরে অন্য দেশে থেকে খাদ্য পণ্য আমদানির পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
খাদ্য মন্ত্রণালয় তথ্যমতে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে খাদ্যের মজুত ২০ লাখ টনের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। ১৫ মে পর্যন্ত সরকারের কাছে ১১ লাখ ২৮ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুত আছে। এর মধ্যে ১ লাখ ১২ হাজার টন আছে গম এবং চাল ও ধান আছে ১০ লাখ ১৫ হাজার টন। সেই হিসেবে আড়াই মাসের ব্যবধানে সেই মজুত ১১ লাখ টনে নেমে এনেছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে রোবো মৌসুমের ধান সংগ্রহ শুরু হলে মজুদ বাড়বে। ভারত গম রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় অন্যদেশ থেকে গম আমদানি বিষয়ে দ্রুত চুক্তির কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
এক বছর আগের তুলনায় ওই মাসে ২০ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়েছিল খাদ্য পণ্যের দাম। এরপর থেকে বিশ্ব বাজারে বিভিন্ন দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এর মধ্যে গত শুক্রবার গম রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত। এতে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও খাদ্য পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারকে বেশ চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলেছে।
ইন্দোনেশিয়া উদ্ভিজ্জ তেল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাত্র ২ সপ্তাহ পর ভারত এ নিষেধাজ্ঞা দেয়। এতে বোঝা যায় যে আরও কিছু দেশও নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আসতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ অবস্থায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আরও বেড়ে যাবে।
২০২০-২১ অর্থবছরে দেশী জাতের চালের উৎপাদন হয়েছে ৫৬ হাজার ৬০ টন, উফশী চালের উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৫২ লাখ ২ হাজার ২৭৬ টন ও হাইব্রিডের উৎপাদন হয়েছে ৪৬ লাখ ২৬ হাজার ৯৪৭ টন। গত অর্থবছরে উফশী চালের উৎপাদন প্রায় ২ শতাংশ ও দেশী জাতের উৎপাদন ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ কমেছে। তবে হাইব্রিডের উৎপাদন বেড়েছে ১২ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আইনুল ইসলাম জানান, শুধু বাংলাদেশেই নয় সারাবিশ্ব এখন খাদ্য মজুদের সমস্যা চলছে। সেইসঙ্গে খাদ্য পণ্যের দাম বেড়েছে। বিশ্বের মধ্যে যে কয়েকটি দেশ খাদ্য রপ্তানি করে থাকে তার মধ্যে ভারত, রাশিয়া এবং ইউক্রেন বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। এই তিন দেশে থেকে আমাদের খাদ্য পণ্য আমদানি হয়ে আসছিলো।
ভারত কয়েক দিন আগে আনুষ্ঠানিকভাবে খাদ্য পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে এই দুই দেশ থেকে পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। সেইসঙ্গে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্য পণ্য অমদানি কমে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে আমাদের মজুদকৃত খাদ্যের উপর। আমাদের এখন উচিৎ হবে অন্যকোনো দেশে থেকে যাতে খাদ্য পণ্য নিয়ে আসা যায় সেই বিষয়ে কাজ করা।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি করা মোট খাদ্যশস্যের (চাল ও গমের) পরিমাণ ছিল ৬৭ লাখ ১ হাজার ৯৭০ টন। এর মধ্যে চাল আমদানি হয়েছে ১৩ লাখ ৫৯ হাজার ও গম আমদানি হয়েছে ৫৩ লাখ ৪২ হাজার ৮০০ টন।
সম্প্রতি খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, খাদ্যের মজুত কমলেও এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কারণ হিসেবে বলেন, বোরো মৌসুমের ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হবে কয়েক দিন পর; চলবে আগস্ট পর্যন্ত। খাদ্যের মজুত ফের বাড়বে। চালের দাম বাড়বে না। বোরোর ভরা মৌসুম শুরু হলে উল্টো কমবে বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।
চলতি বোরো মৌসুমে ১৭ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে সরকার। এর মধ্যে ৬ লাখ ৫০ লাখ টন ধান, ১১ লাখ টন সেদ্ধ চাল ও ৫০ হাজার টন আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামী ২৮ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সংগ্রহ অভিযান চলবে। প্রতি কেজি বোরো ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ধান ২৭ টাকা, সেদ্ধ চাল ৪০ টাকা এবং আতপ চাল ৩৯ টাকা।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে চাপে আছে প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। এ পরিস্থিতিতে শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ওএমএসের আওতা বৃদ্ধি এবং দেশে খাদ্যশস্যের বাফার মজুত কিছুটা হলেও ক্রেতা-ভোক্তার জন্য স্বস্তিদায়ক হবে। তিনি বলেন, ওএমএস কার্যক্রম জোরদার হলে বাজারে ঐ পণ্যগুলোর মূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
যার সুফল ভোক্তারা পাবে। বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকারি গুদামে নিরাপত্তা মজুত হিসেবে অন্তত ১০ লাখ টন চাল থাকতে হয়। এর বাড়তি থাকা আরও ভালো। খাদ্যশস্যের বর্তমান মজুত দিয়ে দেশে চাল ও আটার দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি যেকোনো সংকট মোকাবিলা সম্ভব। রমজান মাসে সরকার এক লাখ পরিবারকে স্বল্প দামে প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করে খুবই ভালো কাজ করেছে। এতে ৫ কোটি মানুষ উপকৃত হয়েছে। পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থামাতে সহায়তা করেছে।