বাংলাদেশ এখন বিপজ্জনক আয় বৈষম্যের দেশ : ড. বারকাত ২০ লাখ ৫০ হাজার ৩৬ কোটি টাকার ‘বিকল্প বাজেট’ প্রস্তাব অর্থনীতি সমিতির
সোহেল রহমান : আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ২০ লাখ ৫০ হাজার ৩৬ কোটি টাকার ‘বিকল্প বাজেট’ প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। এটি চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ৩ দশমিক ৪ গুণ বেশি। চলতি অর্থবছরে সরকার ঘোষিত বাজেটের আকার হচ্ছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। রোববার সমিতির ঢাকাস্থ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত।
সমিতির প্রস্তাবিত বাজেটকে একটি জনগণতান্ত্রিক বাজেট প্রস্তাব দাবি করে তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে- পূর্ণ কর্মনিয়োজন, শিশুর জন্য সুস্থ জীবন, সবার জন্য আবাসন, মূল্যস্ফীতি রোধ—এক্ষেত্রে বাজেট কোনো অভীষ্ট বা লক্ষ্য হবে না, বাজেট হবে লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমমাত্র।
ড. বারকাত বলেন, প্রচলিত বাজেটে জিডিপি বাড়লেও বাড়তে পারে; মাথাপিছু আয় বাড়লেও বাড়তে পারে- কিন্তু বৈষম্য-অসমতা নিরসন হবে না—হবে না মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা অভীষ্ট বাস্তবায়ন। বাংলাদেশ এখন উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশ এবং বিপজ্জনক আয় বৈষম্যের দেশ। মানুষের ক্ষুধার দারিদ্র্যসহ বহুমাত্রিক দারিদ্র্য বেড়েছে। বহুমাত্রিক দারিদ্র্য আরও বাড়ছে-বাড়বে। দারিদ্রাবস্থা নিয়ে সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা—মানুষের কর্মসংস্থানের। জিনিসপত্রের দাম বাড়া বা মূল্যস্ফীতি-গরীবের শত্রু। তবে বেকারত্ব বাড়লে মূল্যহ্রাস বা মূল্যসংকোচন হয় গরিবের মহাশত্রু।
সমিতির বাজেট প্রস্তাবে, মোট রাজস্ব থেকে আয় হবে ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৩৬ কোটি টাকা, যা সরকার প্রস্তাবিত চলমান অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে ৪.৭৬ গুণ বেশি। সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে ২৭টি নতুন উৎস প্রস্তাব করা হয়েছে। সার্বিক ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা (চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে সার্বিক ঘাটতি ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে)। তবে এ বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকারকে সরকারকে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ব্যবস্থা ও বৈদেশিক উৎস থেকে কোন ঋণ গ্রহণ করতে হবে না। বাজেট ঘাটতি পূরণে সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা, সরকারি-বেসরকারি যৌথ অংশীদারিত্ব থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং বন্ড, বিদেশে বসবাসকারী দেশের নাগরিক, বিভিন্ন কোম্পানি ও অন্যান্য খাত থেকে ১ লাখ কোটি টাকা সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়েছে।
সরকারের উদ্দেশ্যে ড. বারকাত বলেন, দেশে বৈষম্য-দারিদ্র্যের বিপজ্জনক প্রবণতা, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, শোভন কর্মবাজারের সংকোচন, একই সঙ্গে এই প্রবণতায় করোনাকালীন এবং ইউরোপে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত, অনিশ্চয়তা এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের বাজেটসহ সকল উন্নয়ন দলিলে কয়েকটি বিষয় খুব গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। বিষয়সমূহ এ রকম: দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বহুমাত্রিক দরিদ্র। আর ধনী-অতিধনী হলেন জনসংখ্যার সর্বোচ্চ ১ শতাংশ। কোভিড-১৯ লকডাউনের প্রভাবে নিরঙ্কুশ দরিদ্র মানুষ হতদরিদ্র-চরমদরিদ্র হয়েছেন; আর নি¤œমধ্যবিত্ত মানুষের ব্যাপকাংশ দরিদ্র হয়েছেন এবং মধ্য-মধ্যবিত্তদের একাংশ বিত্তের মানদ-ে নি¤œগামী হয়েছেন। ফলে এখন একদিকে দরিদ্র মানুষের মোট সংখ্যা কভিড-১৯ সময়ের আগের তুলনায় কমপক্ষে দ্বিগুণ বেড়েছে; আর অন্যদিকে সৃষ্টি হয়েছে নতুন এক দরিদ্র গোষ্ঠী, যারা আগে দরিদ্র ছিলেন না—এরা হলেন নবদরিদ্র। ব্যাপক জনগোষ্ঠীর বিত্তের এই অধোগতি—আগে কখনো এত দ্রুত হয়নি- এ এক নতুন প্রবণতা।
তিনি বলেন, এমতাবস্থায় শুধু আসন্ন ২০২২-২৩ বাজেটই নয়, আগামী অন্তত পাঁচ বছরের বাজেট ও অন্যান্য পরিকল্পনা ও উন্নয়ন নীতি-কৌশল দলিল প্রণয়নে যে বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের প্রধানতম ভিত্তি-নীতি হিসেবে গ্রহণ করতেই হবে তা হলোÑ সমাজ থেকে চার ধরনের বৈষম্য আয় বৈষম্য, সম্পদ বৈষম্য, স্বাস্থ্য বৈষম্য, ও শিক্ষা বৈষম্য চিরতরে নির্মূল করা। এ লক্ষ্যে বাজেটের আয় খাত ও ব্যয় খাতে মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তন করতে হবে। বাজেটে অর্থায়নের উৎস নির্ধারণে দরিদ্র, নি¤œমধ্যবিত্ত ও মধ্যমধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর কোনো ধরনের কর-দাসত্ব আরোপ করা যাবে না। পরজীবী-লুটেরা ধনী-সম্পদশালীদের সম্পদ পুনর্বণ্টন করে তা শ্রেণিমইয়ের নিচের দিকে প্রবাহিত করতে হবে।