স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে না পারায় অপুষ্টির উচ্চ ঝুঁকিতে বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ
মতিনুজ্জামান মিটু : বিশ্বব্যাপী ৭৫ শতাংশ মানুষ তাদের জীবনযাত্রার জন্য কৃষি ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগে এরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যদিও চাহিদার বিপরীতে খাদ্য উৎপাদন পর্যাপ্ত, তথাপি বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে পারছেন না। যা তাদের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও অপুষ্টির উচ্চ ঝুঁকিতে ফেলছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম আরও জানান, কোভিড-১৯ মহামারি, সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈষম্য, ক্রমবর্ধমান মূল্য এবং আন্তর্জাতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে মানুষ সমভাবে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য খেতে পারছেন না। যদিও এদেশ একটি উন্নত বিশ্ব গড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বৈশ্বিক সংকটের মুখে অনেক দেশ পিছিয়ে পড়ছে।
বর্তমান বিশ্বের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, জনসংখ্যা আরও বেশি আন্ত:সংযুক্ত হয়ে উঠেছে। কোনও একটি দেশ পিছিয়ে থাকলে বৈশ্বিক উন্নয়নের শিকলটি ভেঙে যায়। বৈশ্বিক সংকটের মুখে, বৈশ্বিক সমাধান আগের চেয়ে অনেক বেশি দরকার।
এ পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে কৃষির সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বীজ, সারসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণ সহনশীল মূল্যে ক্রয়ের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। শতকরা ৫০ থেকে ৭০ ভাগ পর্যন্ত ভর্তুকি দেওয়ার মাধ্যমে কৃষিযান্ত্রিকীকরণ বিস্তৃত করার পাশাপাশি কৃষকদের ঋণ সুবিধা দেওয়া, নগদ আর্থিক ও উপকরণ সহযোগিতা দেওয়া, ফসলের সময়োপযোগী উপযুক্ত জাত ও টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং স¤প্রসারণ করা হয়েছে। যার ফলে নানা সীমাবদ্ধতা সত্তে¡ও বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশে^ উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষির অব্যাহত উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ বর্তমান বিশে^ পাট রপ্তানিতে প্রথম, পাট ও কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, ধান উৎপাদনে একটানা চার বছর তৃতীয় অবস্থান, একইভাবে সবজি ও পেঁয়াজ উৎপাদনেও তৃতীয়, আম ও আলু উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে।
কোভিড-১৯সহ বর্তমান বৈশি^ক পরিস্থিতিতেও প্রধানমন্ত্রীর প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব ও কার্যকর পদক্ষেপে বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় দেশের এক ইঞ্চি কৃষি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে সে লক্ষ্যে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে কৃষি মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণে ইউনিয়ন পর্যায়ে সবজি বাগান সৃজনসহ সমলয় চাষাবাদ স¤প্রসারণ করা হচ্ছে।
গবেষণা খাতে সরকারের অব্যাহত প্রণোদনা ও উৎসাহে বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন উচ্চফলনশীল জাত, জিংকসমৃদ্ধ ধান, দেশের আবহাওয়া উপযোগী বিভিন্ন ফলের জাতসহ ফসলের জাত উদ্ভাবন করছেন। নতুন উদ্ভাবিত জাতগুলো জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
এরই মধ্যে পেঁয়াজ উৎপাদনে সাফল্য এসেছে, আমদানি নির্ভরতা অনেক কমে কমেছে। দেশে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে তিন বছরমেয়াদি কর্মপরিকল্পনামতে ধানের উৎপাদন না কমিয়েই আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে স্থানীয়ভাবে চাহিদার শতকরা ৪০ ভাগ তেল উৎপাদন করা হবে। ২০৫০ সালে চালের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে ‘ডাবলিং রাইস প্রোডাক্টিভিটি-ডিআরপি’ মডেল নেওয়া হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিভিন্ন রকম উদ্যান ফসল উৎপাদনে পাহাড়ি কৃষির এক বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে উচ্চমূল্যের ফসল কাজুবাদাম ও কফি চাষ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের কার্যকর পদক্ষেপে শুধু খাদ্য উৎপাদনই বাড়ছে না, দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিও প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
এক সময় পাটই ছিল মূলত রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্য। বর্তমানে পাট ছাড়াও ৭০টিরও বেশি সবজি ও ফল বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। ইতোমধ্যে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে এদেশ ছাড়িয়েছে ১০০ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের মাইলফলক। বাংলাদেশের সুস্বাদু আম দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববাজারে স্থান করে নিয়েছে। নিরাপদ কৃষিপণ্য উৎপাদনসহ রপ্তানি বাড়াতে বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চা নীতিমালা-২০২০ করা হয়েছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কৃষি ও কৃষক অন্তপ্রাণ। সমৃদ্ধ, স্বনির্ভর ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া দেশ পুনর্গঠন করতে গিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন দেশের সার্বিক উন্নয়নে কৃষির উন্নতির কোনও বিকল্প নেই। তিনি স্বপ্ন দেখতেন কৃষি বিপ্লবের, তাই তিনি সূচনা করেন সবুজ বিপ্লবের। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে খাদ্য ও পুষ্টির ঘাটতি পূরণে কৃষিবিজ্ঞান, গবেষণা, স¤প্রসারণ, শিল্প ও বাজার উন্নয়নে বিশেষ জোর দেন। মেধাবী শিক্ষার্থীদের কৃষি পেশায় আকৃষ্ট করতে কৃষিবিদদের সরকারি চাকরিতে প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদা দেন। প্রকৃতপক্ষে এদেশের কৃষির আধুনিকায়নের সূত্রপাত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই। জাতির পিতার দর্শনকে অন্তরে ধারণ করে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিবান্ধব নীতি ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে চলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনসহ রূপকল্প ২০৪১ অনুুযায়ী বাংলাদেশকে সুখীসমৃদ্ধ ও উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। পুষ্টি সমৃদ্ধ উন্নত দেশের অভিযাত্রায় সবার কার্যকর অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে।