শেরপুরে গারোদের ওয়ানগালা উৎসব অনুষ্ঠিত
তপু সরকার : গারো পাহাড়ের নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ও কৃষ্টির অন্যতম প্রধান উৎসব নবান্ন বা ওয়ানগালা উৎসব। ফসল ঘরে উঠানোর পর প্রতিবছর উৎসব মুখর পরিবেশে পালন করে ওয়ানগালা উৎসব। রোববার গারো সম্প্রদায়ের লোকেরা খ্রিস্টরাজার মহাপর্ব ও ওয়ানগালা উৎসব করেছে। দিনব্যাপী মরিয়মনগর সাধু জর্জের ধর্মপল্লীর গির্জা চত্বরে ওই উৎসবের আয়োজন করা হয়।
এক সময় গারো পাহাড়ি এলাকায় জুম চাষ হতো। তখন ওই জুম বা ধান ঘরে উঠানোর সময় গারোদের শস্য দেবতা ‘মিসি সালজং’ কে উৎসর্গ করে এ উৎসবের আয়োজন করা হতো।
‘ গারো পাহাড়ের অধিকাংশ গারো ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ায় এখন ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে একত্রে করে পালন করা হয় এ উৎসব। এখন নতুন ফসল কেটে যিশু খৃস্ট বা ঈশ্বরকে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা পালন করেন তারা। সীমান্তবর্তী শেরপুর জেলার গারো পাহাড়ের নৃ-গোষ্ঠীর বা আদিবাসীরা মনে করে ঈশ্বরের দয়ায় তারা ফসল উৎপাদন করে থাকে। তাই তারা প্রতি বছরের ন্যায় আয়োজন করে থাকে নবান্ন বা গারোদের ভাষায় ওয়ানগালা উৎসব।
এবারও গারো পাহাড়ের মরিয়ম নগর ধর্ম পল্লীতে আয়োজন করা হয় ওয়ান গালা উৎসব। একই সঙ্গে পরিবারে ভালোবাসা, আনন্দ, সব পরিবারের মঙ্গল কামনা করা হয় শস্য দেবতার কাছে।
এ সম্প্রদায়ের লোকদের তথ্য মতে, গারোদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব ওয়ানগালা। ‘ওয়ানা’ শব্দের অর্থ দেবদেবীর দানের দ্রব্যসামগ্রী আর ‘গালা’ অর্থ উৎসর্গ করা। দেবদেবীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও মনোবাসনার নানা নিবেদন হয় এ উৎসবে। সাধারণত বর্ষার শেষে ও শীতের আগে, নতুন ফসল তোলার পর এ উৎসবের আয়োজন করা হয়।
এর আগে নতুন খাদ্যশস্য ভোজন নিষেধ থাকে এ সম্প্রদায়ের জন্য। তাই অনেকেই একে নবান্ন বা ধন্যবাদের উৎসবও বলে থাকেন। এ ছাড়া সবাই রঙবেরঙের পোশাক ও পাখির পারক মাথায় দিয়ে লম্বা ডিম্বাকৃতির বাদ্যের তালে তালে নাচে। এই দিন হল বিনোদনের দিন।
পুরুষ ও নারীরা দুইটি আলাদা সারি গঠন করে এবং নাচের তালে তালে এগিয়ে যান। সাথে থাকে মহিষের শিঙে বানানো এক ধরনের আদিম বাঁশির সুর।
মরিয়ম নগর সাধু জর্জের ধর্মপল্লীর গির্জা চত্বরে থক্কা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ওয়ানগালা অনুষ্ঠানের সূচনা করেন মরিয়ম নগর ধর্মপল্লীর সহকারী পাল পুরোহিত ও খামাল ফাদার রব্রাট দিলীপ গোমেজ।
এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মরিয়ম নগর ধর্মপল্লীর পাল পুরোহিত ও খামাল ফাদার বিপুল ডেভিট দাস। বক্তব্য দেন মরিয়ম নগর প্যারিস কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওনারসন চাম্বুগং, আদিবাসী নেতা আলপন্স চিরান প্রমুখ।
উৎসবে ক্রুশচত্বরে বাণী পাঠ (মান্দিতে), খামালকে খুথুব ও থক্কা প্রদান, জনগণকে থক্ক দেওয়া, পবিত্র খ্রিস্টযাগ, দান সংগ্রহ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রার্থনা করা হয়।
গারো সম্প্রদায়ের কয়েকশ মানুষ দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনা করে বিশেষ প্রার্থনায় অংশ নেন। প্রার্থনা পরিচালনা করেন মরিয়ম নগর ধর্মপল্লীর সহকারী পাল পুরোহিত ও খামাল ফাদার রব্রাট দিলীপ গোমেজ। পরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গারোদের নিজস্ব ভাষায় গান ও নৃত্য পরিবেশিত হয়।
মরিয়ম নগর ধর্মপল্লীর পাল পুরোহিত ও খামাল ফাদার বিপুল ডেভিড দাস জানান, ১৯৮৫ সাল থেকে মরিয়ম নগর সাধু জর্জের ধর্মপল্লীর উদ্যোগে ওয়ানগালা উৎসব উদযাপিত হচ্ছে। প্রাচীনকাল থেকে গারো সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্ম ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে তুলে ধরাই এর মূল লক্ষ্য। উৎসব ঘিরে ধর্মপল্লীর পাশে গারোদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও শিশুদের নানা রকমের খেলনা নিয়ে বসে মেলা।