সকল মানুষের কাছে উন্নয়নের ধারা সমানভাবে যাচ্ছে না : ড. দেবপ্রিয়
সোহেল রহমান : বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-এর সম্মাননীয় ফেলো ও এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম-এর আহবায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বাংলাদেশ ক্রমাগতভাবেই উন্নয়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই জাতীয় উন্নয়ন আলেখ্যের স্থানীয় ভিত্তিটা কতখানি মজবুত? বিশেষ করে যারা প্রথাগতভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ আছে তাদের ভূমিকা কতখানি?
তার বলেন, যদিও বাংলাদেশে মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন হচ্ছে, আয় বাড়ছে কিন্তু তার মধ্যে অসমতা বিদ্যমান এবং সকল মানুষের কাছে উন্নয়নের ধারা সমানভাবে যাচ্ছে না। মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমাগত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে যার ফলে নৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দ্বন্দের সৃষ্টি হচ্ছে। এক সময় মধ্যবিত্তরা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতি সহমর্মী ছিলেন, কিন্ত আজ তারা নিজেরাও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
বৃহস্পতিবার মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত এক মিডিয়া ব্রিফিং-এ তিনি এসব কথা বলেন। তৃণমূল পর্যায় থেকে প্রতিনিধিদের সমস্যা অনুধাবনের মাধ্যমে তথ্য উন্মোচন করার লক্ষ্যে সংগঠনের পক্ষ থেকে দেশের সাতটি অঞ্চলে (রংপুর, খুলনা, টাঙ্গাইল,সিলেট, ঠাকুরগাঁও, রাঙ্গামাটি ও চট্টগ্রাম) নাগরিক পরামর্শ সভার আয়োজন করা হয়।
ড. দেবপ্রিয় উপ-আঞ্চলিক নাগরিক পরামর্শ সভা থেকে উঠে আসা মোট ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করে বলেন, যুবসমাজের ক্ষেত্রে মানসম্মত কর্মসংস্থানের অভাবের কথা। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি ও পিছিয়ে পড়া মানুষের জনজীবনে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। নারীদের অবদান সমাজে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলেও তাদের প্রতি সহিংসতা বন্ধ হচ্ছে না। অন্যদিকে পরিবেশ দূষণের এর বিষয়টিও জাতীয় সমস্যা। রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকারি সেবার যথাপোযুক্ত মানের অভাব রয়েছে। এছাড়া বর্তমানে সমাজে একটি ভয়ের সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে মানুষ তাদের বাক-স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং নিজেদের অধিকার আদায়ের কথা বলা থেকে সংযত থাকছে।
ড. দেবপ্রিয় তাঁর উপস্থাপনায় খাতওয়ারি আলোচনায় পাঁচটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, দেশব্যাপী প্রাথমিক শিক্ষা বেড়েছে, কিন্তু শিক্ষার গুণগত মানের পতন হচ্ছে। এছাড়াও স্থানীয় পর্যায়ে অনেকেই আর্থিক সঙ্গতির অভাবে শিক্ষা থেকে ঝড়ে পড়ছে। যে উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে তা দিয়ে সমগ্র শিক্ষার খরচ বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাতে মানের উন্নয়ন হচ্ছে না। যদিও বড় বড় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হচ্ছে, হাসপাতাল হচ্ছে কিন্তু সেখানে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা হচ্ছে না। স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন জায়গায় সুপেয় পানির অভাব এবং পয়ঃনিষ্কাশন এর জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে যা স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও ঝুঁকির সৃষ্টি করছে। এছাড়াও সামাজিক সুরক্ষার পরিমাণ পর্যাপ্ত নয়। এছাড়াও রয়েছে সড়ক নিরাপত্তার অভাবের কথা। সঠিক পরিবহন ব্যবস্থার অভাবের ফলে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ ও ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে নারী, যুব এবং প্রবীণরা নানারকম বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। সামাজিক এবং পারিবারিক মÐলে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে যুবরা সমাজ থেকে বিযুক্ত হচ্ছে যার প্রধান কারণ কর্মসংস্থানের অভাব হলেও এর পাশাপাশি আছে সোশ্যাল মিডিয়ার বিভ্রান্তি, মাদকাসক্তি, মানসিক বিষণ্ণতা, উগ্রবাদের প্রতি আকর্ষণ ইত্যাদি।
প্রবীণদের জন্য সুযোগের অভাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে বা ব্যক্তিখাতে তাদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। এছাড়াও নীতি নির্ধারণে তাদের প্রতি মনোযোগের অভাব রয়েছে। স্থানীয় পর্যায় থেকে শারীরিক এবং মানসিক প্রতিবন্ধীদের কথাও উঠে এসেছে যারা সমাজে এমনকি পরিবারেও নিগৃহীত হয়। সবশেষে তিনি হিজড়া জনগোষ্ঠীর কথা বলেন, যাদের প্রতি ঘৃণামূলক আচরণের কথা স্থানীয় আলোচনায় উঠে এসেছে। সর্বোপরি প্রবীণদের প্রতি সহমর্মিতার অভাবের কথা নাগরিক পরামর্শ সভাগুলোতে উঠে এসেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আজকে তৃণমূলের বক্তব্য উপস্থাপন হয়েছে যেখানে দুইটি বিষয় উঠে এসেছে, তা হলোÑ বণ্টনের দিক এবং আকাঙ্ক্ষার দিক। উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে গড়ের সমীকরণ আমাদের সমাজে আছে সেখান থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। এই গড়ের কাছাকাছি স্থানীয় মানুষদের তখনই আনা সম্ভব যদি ইতিবাচক বৈষম্যমূলক আলোচনা হয় এবং তা হতে হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে।
তিনি বলেন, দৃশ্যমান যে উন্নয়ন হয়েছে, সেখানের দৃশ্যের সাথে মানের ব্যাপারেও গুরুত্ব দিতে হবে। এ জায়গাগুলো অর্জন এর জন্য তিনি সরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের নতুন সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন এবং গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।