কাটেনি কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার অনিশ্চয়তা
মতিনুজ্জামান মিটু : কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ ও সংগ্রহমূল্য নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন দেশে রয়েছে ‘এগ্রিকালচারাল প্রাইস কমিশন’। বাংলাদেশে এধরণের প্রাইস কমিশন গঠনের দাবি দীর্ঘদিনের। দেশের জাতীয় কৃষিনীতিতেও একটি প্রাইস কমিশন গঠনের প্রতিশ্রæতি দেওয়া হয়েছে। অথচ তার বাস্তবাায়ন আজও হয়নি। এবিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
ভারত, পাকিস্তাান ও শ্রীলংকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে কৃষিমূল্য কমিশন কার্যকর রয়েছে। ভারতে কৃষিমূল্য কমিশন স্থাপিত হয় ১৯৬৫ সালে। এখনও তা অব্যাহতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এতে একজন চেয়ারম্যান এবং দু’জন সদস্যসহ প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্য লোকবল রয়েছে। একমিশনের কাজ হলো পণ্যের উৎপাদন, ন্যূনতম সমর্থন মূল্য এবং কৃষিপণ্যের রপ্তানি মূল্য নির্ধারণ ও আমদানি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা। মাঠের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং কৃষি উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে কমিশন তাদের সুপারিশ করে থাকে। তাদের সুপারিশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবাই মেনে নেয়।
কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ ও কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়া প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিকল্পনা, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও আইসিটি উইং এর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ও খামারবাড়ি’র কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. শাহীদুল ইসলাম জানান; কৃষক চায় তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য, ভোক্তা চায় কম মূল্য আর ব্যবসায়ী চায় কম দামে কিনে বেশিতে বেচতে। এতিন মূল্য সমন্বয় করে সবাইকে সন্তুষ্ট করা বেশ কঠিন কাজ। ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফার জন্য বিভিন্ন রকম যুক্তি দেখায়। বাস্তবে কৃষকের পাওয়াআর খুচরা দামের মধ্যে ব্যবধান অনেক। ব্যবসায়ীদের বেশি মুনাফা লাভের মানসিকতা থেকে এটা হয়। তাই প্রায়ই ক্রেতারা সরকারের কাছে সহনীয় দাম নির্ধারণের দাবি উঠান। কৃষি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়াটা আধুনিক বাজার ব্যবস্থাপনার ধারণার মধ্যে পড়ে। এ জন্য মূল্য কমিশন গঠনেরও অনেকে প্রস্তাব করেন। মূলত ফড়িয়াদের দৌরাতœ্য এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের যোগসাজসই কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার অন্যতম কারণ। মৌসুমে জোগান বেশি থাকলে কৃষি পণ্যের দামও কমে যায়। কিন্তু অমৌসুমে উৎপাদিত পণ্যে কৃষক ভালও দাম পায়। তাই কৃষকদের অমৌসুমে ফসল উৎপাদনের ওপর বেশি জোর দিতে হবে। দুর্গম উৎপাদনস্থল, বিক্রেতা বেশি ক্রেতা কম, পরিবহন সংকট, পাহাড়ি পথ, ভঙ্গুর রাস্তাঘাট, রোগ ও পোকা আক্রান্ত পণ্য, অপরিষ্কার পণ্য, বাসি বা থেঁতলানো বা আঘাতপাওয়া পণ্য-এসব কারণেও অনেক সময় কৃষক ন্যায্যমূল্য পান না।
প্রচলিত বাজারব্যবস্থায় কৃষি পণ্য উৎপাদিত হওয়ার পর কৃষক থেকে ফড়িয়া বা বেপারি বা পাইকারি ব্যবসায়ী সরাসরি কিনে থাকেন। এদের মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীও বলা য়ায়। তারা কেনা পণ্য সরাসরি আড়তে তোলেন। আড়তদার কমিশন রেখে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পণ্য বিক্রয় করে থাকেন। কৃষক পর্যায়ের অভিযোগ তারা ফড়িয়া বা বেপারি বা পাইকার বা আড়তদারদের যোগসাজশের কারণে তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য পাননা। কৃষকদের সংগঠন না থাকার কারণে তাদের দরকষাকষির সুযোগ থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে সংগঠন থাকলেও তা দুর্বল প্রকৃতির। ব্যবসায়ীরা সংখ্যায় কম হলেও নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া থাকে। এ কারণে কৃষক তার ইচ্ছামতো দাম হাঁকাতে পারে না। বেশির ভাগ কৃষিপণ্য যেহেতু পচনশীল, তাই বেশি দিন ধরে রাখা যায় না। আবার ধরে রাখার মতো সংরক্ষণাগার বা হিমাগারের ব্যবস্থা না থাকার কারণে অনেকটা বাধ্য হয়ে কৃষক তড়িঘড়ি করে বা আগাম কৃষি পণ্য বিক্রি করে দেনা। ফলে ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে কৃষক বঞ্চিত হয়।
কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের জন্য বাংলাদেশ সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান ও গম কিনে থাকে। একইভাবে ভারতের কেরালা রাজ্যেও আনারস বিক্রির ওপর রাজ্য সরকার নির্দিষ্ট দাম নির্ধারণ করে দেয়। এতে ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়েই সন্তুষ্ট থাকে। সেখানে কেরালা পাইনঅ্যাপেল সিটি নামে একটি বৃহৎ আকারের মার্কেট রয়েছে। সেখান থেকে পুরো ভারতসহ পাকিস্তানের কিছু রাজ্যে আনারস সররবাহ করা হয়। ‘কেরালা পাইনঅ্যাপেল কৃষক সমবায় সমিতি’ নামে ১০০০ সদস্যের রেজিস্টার্ড একটি শক্তিশালী কৃষক সংগঠন রয়েছে। সংগঠনকে শক্তিশালীকরণে রাজ্য সরকার যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। শক্তিশালী কৃষক সংগঠনের মাধ্যমে কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ সেখানকার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এদেশেও কৃষক সংগঠন শক্তিশালীকরণের মধ্য দিয়ে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা যেতে পারে।
কৃষি মূল্যনীতির অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে পণ্যের ন্যূনতম সমর্থনমূল্য নির্ধারণ করা। এটা প্রতি বছরই সরকারিভাবে নির্ধারণ করা দরকার। কৃষকের জন্য উৎপাদিত পণ্যের ন্যূনতম মুনাফা নিশ্চিত করা এর উদ্দেশ্য। ভারতে বর্তমানে ২৩টি কৃষিপণ্যের সমর্থনমূল্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। নির্ধারিত মূল্যের নিচে যাতে বাজারদর নেমে না যায় সে জন্য সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে উৎপাদিত পণ্য ক্রয় করে নেয় সরকার।
২০১৮-১৯ সালের বাজেটে ভারত সরকার বিভিন্ন কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করেছে উৎপাদন খরচের ওপর শতকরা ৫০ শতাংশ মুনাফা হিসাব করে। মোট উৎপাদিত পণ্যের শতকরা ১৫ শতাংশ কেনা হচ্ছে এরকম পূর্বনির্ধারিত দামে। বাংলাদেশে ন্যূনতম সমর্থন মূল্য নির্ধারণের ব্যবস্থা থাকা দরকার। তবে প্রচলন আছে ধান-চাল ও গমের সংগ্র্রহ মূল্য নির্ধারণের। এটা সাধারণত উৎপাদন খরচের ওপর ৬ থেকে ১০ শতাংশ মুনাফা দেখিয়ে নির্ধারণ করা হয়। এর পরিধিও সীমিত। মোট উৎপাদনের মাত্র ৪ থেকে ৫ শতাংশ খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা হয় উৎপাদন মৌসুমে। তার বেশির ভাগ ক্রয় করা হয় স্থানীয় ব্যবসায়ী ও চাতালের মালিকদের কাছ থেকে। কৃষক তাতে সরাসরিভাবে লাভবান খুবই কম হয়। ফলে এদেশে প্রচলিত উৎপাদিত পণ্যের সংগ্রহ মূল্য স্থানীয় বাজারে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। তাতে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয় কৃষক। অনেক সময় উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে কৃষক তার উৎপাদন খরচটুকুও ঘরে নিয়ে আসতে পারেন না।
কৃষিপণ্যের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণের জন্য কিছু নিয়ম প্রচলিত আছে। সেক্ষেত্রে আগের বছরের পণ্যমূল্য, উৎপাদন খরচ, খোলা বাজারে পণ্যমূল্যের চালচিত্র, আন্তর্জাতিক বাজারদর, সরকারি মজুদ ও মূল্যস্ফীতির হার ইত্যাদি প্রধান বিবেচ্য বিষয়। এদেশে বর্তমানে ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয় মূলত উৎপাদন খরচের ওপর ভিত্তি করে।
কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে করণীয় প্রসঙ্গে এই দুই কর্মকর্তা জানান, কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হলে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের সরাসরি বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নির্দিষ্ট এলাকাভিত্তিক কৃষক সংগঠন তৈরি করে গ্রæপ মার্কেটিং এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে কৃষকদের সংঘবদ্ধ হতে হবে। মাঠ পর্যায়ে কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর কর্মীরা উৎপাদনের পিছনে যে পরিমাণ শ্রম ও সময় ব্যয় করেন তার কিছুটা সময় ফসল বিক্রয়ে সহায়তা দিতে হবে। কৃষি পণ্য বিপণনে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর সহায়তা করে থাকে। তাই কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের জনবলকাঠমো উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত দরকার। সে পরিকল্পনাও সরকারের রয়েছে। ইতোমধ্যে কৃষিমন্ত্রী এব্যাপরে বেশ উৎসাহী পদক্ষেপ নিয়েছেন।
কৃষকদের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিশ্চিতের জন্য উৎপাদন খরচ কমানোর দিকে প্রথম নজর দেওয়া দরকার। সেসঙ্গে ব্যবসায়ী আর কৃষকদের মাঝে যোগাযোগ স্থাপন করা দরকার। মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ দরকার। কৃষক-গবেষক-স¤প্রসারণ কর্মী-ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা জরুরি। কৃষির বিভিন্ন প্রকল্পে কৃষক প্রশিক্ষণে স্থানীয় ব্যবসায়ীকে অন্তর্ভুক্ত করে আধুনিক বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর পাঠ দেওয়া যেতে পারে। এতে কৃষক ও ব্যবসায়ী আধুনিক বাজারজাতকরণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করবেন। নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের জন্য কৃষকের দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়ানো, সংগঠন তৈরি ও শক্তিশালীকরণ, নেতৃত্বের উন্নয়ন, গ্রæপ বা সমবায়ভিত্তিক মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি অভ্যস্তকরণ, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের বৃহৎ বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণ, মিডিয়াতে বাজার তথ্য স¤প্রচার, পণ্য পরিবহনকালীন চাঁদা বন্ধকরণ, অপচয় কমানো, প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতকরণ, বøক বা ইউনিয়ন পর্যায়ে পর্যাপ্ত কালেকশন সেন্টার স্থাপন, ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি ও বিপণন সেবা চালুকরণ, উপজেলা পর্যায়ে সংরক্ষণাগার বা প্যাক-হাউজ স্থাপন এবং জেলা পর্যায়ে কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করা দরকার। প্রক্রিয়াজাতকারীদের সঙ্গে কনটাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে চাহিদাভিত্তিক পণ্য উৎপাদন করলে ন্যায্যমূল্য পাওয়া সহজ হবে।
বর্তমান বিশ্ব যখন মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাসী তখন বিশ্ব বাজারের প্রতিযোগিতা মোকাবেলা করতে হলে পণ্যের উপযুক্ত ও আধুনিক প্রক্রিয়াজাতের ব্যবস্থা নিতে হবে। সর্বোপরি, কৃষিপণ্য উৎপাদন ও বিপণন খরচের খাতগুলো চিহ্নিত করে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমাতে হবে। এতে করে একদিকে যেমন নিজস্ব পণ্যের উপযুক্ত মূল্য পাওয়া নিশ্চিত হবে অন্যদিকে ক্রেতাও অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে ক্রয় করতে পারবেন।