আমাদের জীবনে একটি বিশ্বকাপ আজ শেষ হলো
মনিজা রহমান
মেয়েটার হাতে একটা চাবির গোছা। তাতে অনেকগুলো চাবি। এতো চাবি নিয়ে ঘুরতে সাধারণত কাউকে দেখা যায় না। তাই মন্তব্য না করে পারলাম না। আমার মন্তব্যের পরে ওর বান্ধবীও হেসে কি যেন ঠাট্টা করল।
কিছু মুখ থাকে মনে হয় সারাক্ষণ হাসে, মেয়েটার চেহারাও তেমন। ও বলল, এই চাবিগুলির একটা আমার বাসার, একটা অফিসের, একটা জিমের লকারের, একটা গাড়ির, একটা আমার প্যারেন্টসের বাসার, দুইটা আমার আংকেল আর আন্টির বাসার, তিনটা আমার তিনজন বন্ধুর বাসারৃ. হাহাহা।’
‘এতোগুলো চাবি নিয়ে ঘোরা খুব হাস্যকর, তাই না?’ মেয়েটা ওর বান্ধবী আর আমার কাছে এরপর জানতে চাইল।
‘মোটেও না।’ আমি বললাম, ‘অনেকগুলো চাবি থাকা মানে তুমি খুব ভালো মানুষ। সবাই তোমার ওপর অনেক নির্ভর করে!’ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এই দেশে চাবি জিনিষটা কত গুরুত্বপূর্ণ। বাসায় ঢোকার চাবি না থাকলে মাইনাস তাপমাত্রায় পথে পথে ঘুরতে হয়। এজন্য সবাই মূল চাবির অনেকগুলো ‘ডুপ্লিকেট’ করে অন্যদের দিয়ে রাখে।
চাবি দিয়ে আলাপ শুরু হল গিয়ে ঠেকল ফুটবলে। মেয়েটার জন্ম নিউইয়র্কের লংআইল্যান্ডে। এই দেশে জন্ম নেয়া একটা মেয়ে যে চলতি বিশ্বকাপের কোন ম্যাচ মিস করেনি। তথ্যটা আমাকে বিস্মিত করল। পরে মেয়েটা হেসে বলল, আমি নিজেই একজন সকার খেলোয়াড়।
কথাটা শুনেই মনটা এতো ভালো হয়ে গেল যে বলার নয়। খেলোয়াড় মেয়েরা আমার এমনিতে খুব প্রিয়। আর ফুটবল খেলে যে সব মেয়েরা, তারা তো একটু বেশী প্রিয়। মনে মনে ভাবলাম, যদি আমার কোন মেয়ে থাকতো নিশ্চয়ই তাকে আমি ফুটবলার বানাতাম।
ভাবতে ভাবতে মোবাইল ওপেন করে বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের ছবি দেখালাম ওদের। বললাম, ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলংকা-নেপালদের হারিয়ে আমাদের মেয়েরা এখন সাফে চ্যাম্পিয়ন!
ওরা দুই বান্ধবী হুমড়ি খেয়ে পড়ে বলতে গেলে ছবিগুলো দেখতে লাগল। আর বার বার ‘ওয়াও’ ‘ওয়াও’ করল। মেয়ে দুটি দেখতে এতো মিষ্টি। আমি ইংরেজী উপন্যাস পড়ার সময়ে অসম্ভব মানবিক চরিত্রের নায়িকার যে চেহারা কল্পনা করি, মেয়ে দুটি যেন সেইরকম!
জন্মভূমি “আমেরিকা” মেয়েটির প্রিয় দল ছিল এবারের বিশ্বকাপে! তারপর? মেয়েটা বলল, ‘আমার পূর্বপুরুষ পর্তুগাল থেকে এদেশে এসেছে। আমেরিকার পরে প্রিয় দল তাই পর্তুগাল।’
নিউইয়র্কের এস্টোরিয়ায় গ্রীক-ইতালিয়ানদের মতো অনেক পর্তুগীজ মানুষ থাকে শুনেছি, কিন্তু এর আগে কারো সঙ্গে পরিচয় হয়নি। আমি ওকে বললাম, ‘জানো ভারতবর্ষ আবিস্কার করেছে পর্তুগীজরা! এজন্য উপমহাদেশের বেশীরভাগ খ্রিস্টান পর্তুগীজ বংশোদভূত ।
শুনে মেয়েটা খুব খুশী হল। ভাবলাম, এবারের বিশ্বকাপের ট্রফি পর্তুগালের হাতে গেলে খারাপ হত না। ওরা তো কখনও চ্যাম্পিয়ন হয়নি বিশ্বকাপে! অথচ কত মেধাবী ফুটবল খেলোয়াড় ও কোচের জন্ম দিয়েছে।
রবিবার বিশ্বকাপ ফাইনালে গেবি রিকিয়ার্ডি নামের মেয়েটা ‘আর্জেন্টিনা’ কে সমর্থন দেবে। কারণ হল- লিয়নেল মেসি। ওর মতো একজন খেলোয়াড়ের হাতে একবার বিশ্বকাপের ট্রফি উঠবে না, তাই কি হয়! মেয়েটা এরপর বলল, ‘কাতার বিশ্বকাপ খুব উপভোগ্য ছিল। খারাপ লাগছে আগামীকাল শেষ হয়ে যাবে খেলা।’
কথাটা শুনে আমারও মনে হল, আসলেই আমাদের জীবনে ছিল একটা বিশ্বকাপ, সেটাও রবিবার শেষ হয়ে গেল। এবার বিশ্বকাপ গেবির মতো আমারো খুব উপভোগ্য মনে হয়েছে! আপনার?