বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তায় ভারতের রেশন ব্যবস্থার অনুসরণ করা যেতে পারে
কল্লোল মোস্তফা
সার্বজনীন রেশন ব্যবস্থা যে কতো গুরুত্বপূর্ণ তা করোনাকালে এবং সা¤প্রতিক দ্রব্যমূল্যের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধির সময়ে কঠিন ভাবে আমরা উপলব্ধি করছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও রেশন ব্যবস্থা অব্যাহত ছিলো। সীমিত, দুর্বল ও অগোছালো ব্যবস্থা হলেও ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষকালে এই রেশন ব্যবস্থাই শুধু গরীব নয় মধ্যবিত্ত পর্যন্ত অনেককে রক্ষা করেছে। বিশ্বব্যাংক ও ইউএসআইডির যৌথ প্রকল্পে দুর্নীতি, অপচয় ইত্যাদি অজুহাত তুলে ৭০ দশকের শেষ থেকে এই ব্যবস্থারই উচ্ছেদ কর্মসূচি শুরু হয়। অন্যদিকে ভারতে একইরকম সমস্যা থাকলেও তার সমাধানে সফলভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়। তার মধ্য দিয়ে কীভাবে ভারতে একটি শক্তিশালী স্বচ্ছ রেশন ব্যবস্থা কাজ করছে বর্তমান প্রবন্ধে সেটাই বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই অভিজ্ঞতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা শুধু কয়েকটি পেশার জন্য নয়, সর্বজনের অধিকারের অংশ হিসেবে সার্বজনীন রেশন ব্যবস্থা বাংলাদেশে অবশ্যই চালু করতে হবে।
ভারতে বহু বছর ধরেই গণবণ্টনব্যবস্থা (পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম) চালু থাকলেও ঘধঃরড়হধষ ঋড়ড়ফ ঝবপঁৎরঃু অপঃ-২০১৩ বা জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন-২০১৩-এর মাধ্যমে গ্রামের ৭৫ শতাংশ এবং শহরের ৫০ শতাংশ নাগরিকের জন্য এটাকে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক মৌলিক অধিকারে পরিণত করা হয়। ভারতের গণবণ্টনব্যবস্থা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার যৌথভাবে বাস্তবায়ন করে। কেন্দ্রীয় সরকার ফুড করপোরেশন অব ইন্ডিয়ার (ঋঈও) মাধ্যমে খাদ্যশস্য ক্রয়, মজুত, পরিবহণ ও রাজ্য সরকারগুলোর মধ্যে বিতরণে কাজ করে। অন্যদিকে রাজ্য সরকারের কাজ হলো, রেশন বিতরণের কাজ মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করা অর্থাৎ রেশনের জন্য উপযুক্ত পরিবার শনাক্ত করা, রেশন কার্ড ইস্যু করা, ফেয়ার প্রাইস শপ বা রেশনের দোকানগুলোর তত্ত¡াবধান করা ইত্যাদি।
ভারতীয় জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন বা এনএফএসএ-র আওতায় দুই ধরনের রেশন কার্ড রয়েছে-অতিদরিদ্রদের জন্য অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনা (অঅণ) এবং অগ্রাধিকারভুক্তদের জন্য প্রায়োরিটি হাউসহোল্ড (চঐঐ) রেশন কার্ড। আইনানুসারে, এসব এনএফএসএ রেশন কার্ডের মাধ্যমে ফেয়ার প্রাইস শপ বা রেশনের দোকান থেকে অঅণ কার্ডধারী অতিদ্ররিদ্ররা প্রতি মাসে ৩৫ কেজি এবং চঐঐ কার্ডধারীরা পরিবারের সদস্যপিছু পাঁচ কেজি করে চাল-আটা যথাক্রমে দুই ও তিন টাকা কেজি দরে ক্রয় করতে পারে। সবশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে এনএফএসএ কার্ডধারীর সংখ্যা প্রায় ২৩ কোটি ৭৫ লাখ, যার আওতায় সুবিধাভোগী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৮০ কোটি।
ভারতের গণবণ্টনব্যবস্থা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার যৌথভাবে বাস্তবায়ন করে। গ্রাম ও শহরের ৭৫ শতাংশ ও ৫০ শতাংশ জনসংখ্যার অনুপাতকে জাতীয় পর্যায় থেকে রাজ্য পর্যায়ে ভাগাভাগি করে দেওয়ার ফলে দরিদ্রতর রাজ্যগুলোর ভাগে তুলনামূলক বেশি রেশন কার্ড পড়ে। দেখা যায়, অনেক রাজ্যে রেশন কার্ডের আওতা কমে গেছে। কারণ, রাজ্যগুলো কেন্দ্র-নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে ইতোমধ্যে আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে রেশন প্রদান করছিল। ফলে এনএফএসএ-র আওতায় কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দের বাইরে বিভিন্ন রাজ্য সরকার যেসব রেশন কার্ড ইস্যু করে, যেগুলোকে বলা হয় নন-এনএফএসএ রেশন কার্ড। বিভিন্ন রাজ্য সরকার নিজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী এসব নন-এনএফএসএ কার্ডধারীদের রেশন প্রদান করে থাকে।৭ যেমন, মিজোরাম সরকার ১৫ রুপি দরে ৮ কেজি করে চাল সরবরাহ করে।৮ মেঘালয় সরকার ১০-১২ টাকা কেজি দরে পরিবারপ্রতি ৮ কেজি করে চাল এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৭-৮ টাকা কেজি দরে ১-৫ কেজি আটা সরবরাহ করে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের খাদ্য সুরক্ষা যোজনা রেশন কার্ড-১-এর মাধ্যমে ২ টাকা কেজি দরে ২ কেজি চাল এবং ৩ কেজি গম পাওয়া যায়। ভারতীয় জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন বা এনএফএসএ-র আওতায় দুই ধরনের রেশন কার্ড রয়েছে-অতিদরিদ্রদের জন্য অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনা (অঅণ) এবং অগ্রাধিকারভুক্তদের জন্য প্রায়োরিটি হাউসহোল্ড (চঐঐ) রেশন কার্ড। আবার অনেক ক্ষেত্রে রাজ্য নিজস্ব অর্থায়নে কেন্দ্র-ঘোষিত মূল্যের তুলনায় কম দামে রেশন বিক্রয় করে। তামিলনাড়– রাজ্যে উভয় ধরনের এনএফএসএ রেশন কার্ডের আওতায় চাল কেজিপ্রতি ২ টাকার বদলে বিনা মূল্যে প্রদান করা হয়। একইভাবে ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড এবং ওড়িশায় কেন্দ্রীয় সরকারের চেয়ে কম মূল্যে চাল বিক্রয় করা হয়। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের বিতরণ করা চাল, গম, চিনি ও কেরোসিনের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজ্য ডাল, ভোজ্য তেল, আয়োডিনযুক্ত লবণ, মসলা ইত্যাদিও স্বল্পমূল্যে রেশনের দোকানে বিক্রয় করে থাকে। যেমন, বাজারে অড়হর ডালের দাম কেজিপ্রতি ১২০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ায় গুজরাট সরকার ফেব্রæয়ারি ২০২২-এ ১৭ হাজার রেশনের দোকানে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রির ঘোষণা দেয়। শুরুতে অতিদরিদ্র ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্তদের রেশন কার্ড তৈরি হয় ২০১১ সালের আর্থসামাজিক ও জাতিভিত্তিক জনশুমারির পরিসংখ্যানের নিরিখে। ইন্টারনেটে প্রত্যেক গ্রাম ও রেশন ডিলারের জন্য এই তালিকা পাওয়া যায়, ফলে জালিয়াতি করে অনুপযুক্ত কাউকে কার্ড প্রদান করা হলে তা শনাক্ত করা যায়।১৪ আইনানুসারে সরকারের দায়িত্ব হলো, প্রতিবছর নামের তালিকা যাচাই-বাছাই করে অনুপযুক্তদের বাদ দেওয়া এবং উপযুক্তদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা। এই গণবণ্টনব্যবস্থা থাকার সুবিধা হলো, রেশনের দোকানের মাধ্যমে বণ্টন করার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য সরকারকে কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে (মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস) কিনতে হয়, ফলে একদিকে কৃষকরা ফসলের ন্যায্যমূল্য পেতে পারেন, অন্যদিকে দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এবং সার্বিকভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যের ওপর সরকারের একধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকে। অতিদরিদ্র ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্তদের রেশন কার্ড তৈরি হয় ২০১১ সালের আর্থসামাজিক ও জাতিভিত্তিক জনশুমারির পরিসংখ্যানের নিরিখে। ইন্টারনেটে প্রত্যেক গ্রাম ও রেশন ডিলারের জন্য এই তালিকা পাওয়া যায়, ফলে জালিয়াতি করে অনুপযুক্ত কাউকে কার্ড প্রদান করা হলে তা শনাক্ত করা যায়। ১৪ আইনানুসারে সরকারের দায়িত্ব হলো, প্রতিবছর নামের তালিকা যাচাই-বাছাই করে অনুপযুক্তদের বাদ দেওয়া এবং উপযুক্তদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা। (আনু মুহম্মদ সম্পাদিত সর্বজন কথা থেকে সংক্ষেপে নেয়া)