আখ চাষ ও রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিশিল্পে সংকট কেন?(১)
মোশহিদা সুলতানা
ও কল্লোল মোস্তফা
দীর্ঘদিন ধরে গভীর সংকটে নিমজ্জিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চিনিশিল্প প্রতিষ্ঠান ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তা ও আখচাষিদের জীবন-জীবিকা। রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলোর উৎপাদিত চিনি অবিক্রীত পড়ে আছে গুদামে। এসব কারখানায় চিনির উৎপাদন খরচ চিনির বাজারমূল্যের দ্বিগুণেরও বেশি। লোকসান দিয়ে বিক্রি করা হলেও বেসরকারিভাবে আমদানীকৃত চিনির সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না এই চিনি। ফলে চিনিকলের শ্রমিকরা নিয়মিত বেতন পান না, প্রায়ই বেতনের বদলে চিনি প্রদান করা হয় তাদের। আখচাষিরা আর চিনিকলগুলোতে আখ সরবরাহ করতে চান না, দিনে দিনে কমে যাচ্ছে আখ চাষ। চিনিকলের কাছে আখ বিক্রি করে পাওনা আদায়ের জন্য মাসের পর মাস ঘুরতে হয় তাদের। এদিকে পর্যাপ্ত আখ না পাওয়ায় চিনিকলের যন্ত্রপাতি ও শ্রমশক্তিবছরের বেশিরভাগ সময় অব্যবহৃত থাকে এবং আখ থেকে চিনি উৎপাদনের খরচ বাড়তে থাকে। চিনি খাতের এই সংকট নিরসনে ২০১৫ সালের শেষের দিকে এসে সরকার কিছু বাজার নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে দুই দফায় নতুন করে আমদানির ওপর সংরক্ষণমূলক শুল্ক আরোপ এবং ভ্যাট আরোপ। যুক্তি হচ্ছে, শুল্ক আরোপ করে বেসরকারি আমদানি নিয়ন্ত্রণে রাখা ও পিছিয়ে থাকা রাষ্ট্রীয় খাতকে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। এই বাজার নিয়ন্ত্রণ নীতি আসলে এই চিনিশিল্পকে রক্ষা করে টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে কি না-এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে আমরা চিনিশিল্পের সংকটের কার্যকারণ ও তার সমাধানের উপায় অন্বেষণ শুরু করি। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও মাঠপর্যায়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণের মধ্য দিয়ে এই প্রবন্ধে চিনিশিল্পের সংকট ও সমাধানের বিবিধ উপায় অন্বেষণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের চিনিশিল্প: ইতিহাস ও গুরুত্ব
প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশ এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে গুড়, সুক্কার (Sukker) বা খÐেশ্বরী (Khandeswari) তৈরির জন্য আখের চাষ হয়ে আসছে (বাংলাপিডিয়া, ২০১৪)। সপ্তম শতাব্দীতে চিনিশিল্পের প্রযুক্তি শেখার জন্য চীনাদের এদেশে আসার কথা জানা যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মার্কোপোলো এদেশে চিনিশিল্পের অস্তিত্ব লক্ষ করেন। সপ্তম শতাব্দীতে এদেশ থেকে চিনি রপ্তানি হতো বসরা, বন্দর আব্বাস, জেদ্দা ও মাসকটে। এই এলাকা থেকে উপমহাদেশের মাদ্রাজ, সুরাট ও সিন্ধু অঞ্চলে চিনি রপ্তানি হতো। এ অঞ্চল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে যাওয়ার পর এখান থেকে প্রতিবছর চিনি রপ্তানি হতো ১৮২০ টন, যা থেকে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা কমপক্ষে ৫০ শতাংশ মুনাফা অর্জন করত। ওয়েস্ট ইন্ডিজে উৎপাদিত চিনির স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশের চিনির ওপর শুল্ক আরোপ করে। এই নীতি সত্তে¡ও এ অঞ্চলের চিনিশিল্প বিকাশ লাভ করে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কোটচাদপুর, কেশবপুর, ত্রিমোহনী, ঝিকরগাছা, নারিকেলবাড়ী, চাদগাজী, চিত্রা ও ভৈরব এলাকা চিনিশিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতো। এসময় শুধু উত্তরবঙ্গই ৭৭ হাজার ৯৮৪ টন চিনি উৎপাদন করত। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও এই এলাকায় ১৭টি চিনিকল ছিল। কিন্তু এরপর ঔপনিবেশিক নীতির চাপে চিনিকলগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারত ভাগ হওয়ার সময় বাংলাদেশ অঞ্চলে ৫টি ব্যক্তিমালিকানাধীন চিনিকল ছিল, যার সম্মিলিত উৎপাদনক্ষমতা ছিল ৩১ হাজার টন (মুহাম্মদ, ১৯৮০)।
বর্তমানে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের অধীনে মোট ১৫টি চিনিকল চালু রয়েছে, যার মধ্যে ৩টি ব্রিটিশ আমলে, ৯টি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে এবং ৩টি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্থাপিত হয়েছে। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ২৭ নম্বর আদেশবলে বাংলাদেশ সুগার মিলস করপোরেশন গঠিত হয়। ১ জুলাই ১৯৭৬ বাংলাদেশ সুগার মিলস করপোরেশন ও বাংলাদেশ ফুড অ্যান্ড অ্যালাইড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনকে একীভূত করে বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন গঠন করা হয় (বিএসএফআইসি, ২০১৪খ)। প্রতিষ্ঠানটির নাম চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন হলেও এখন আর এর অধীনে কোনো খাদ্যশিল্প প্রতিষ্ঠান অবশিষ্ট নেই। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত এর আওতায় থাকা ঘানির তেল, তেল রিফাইনারি, টোব্যাকো কোম্পানি, কোল্ড স্টোরেজ ও মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ, ময়দা, বিস্কুট ও কোল্ড ড্রিংকস, বেকারিসহ মোট ৫৭টি খাদ্যশিল্প প্রতিষ্ঠান এবং ৩টি চিনিকল (কালিয়াচাপড়া, দেশবন্ধু ও ন্যাশনাল) বেসরকারি করা হয়েছে (বিএসএফআইসি, ২০১৪)।
বাংলাদেশের চিনিকলগুলোতে সরাসরি ১৬ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়। আর আখ চাষের ওপর নির্ভর করে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাঁচ লাখ চাষিসহ প্রায় ৫০ লাখ মানুষের জীবিকা। কৃষিভিত্তিক চিনিশিল্পকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ এলাকায় রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, ব্যাংক, হাটবাজার, অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ও প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। চিনির উপজাত চিটাগুড়, আখের ছোবড়া ইত্যাদি কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করেও বিভিন্ন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে, যার মাধ্যমে বহু কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে (বিএসএফআইসি, ২০১৪)।
রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় এবং দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চিনির মূল্য নিয়ন্ত্রণ। ২০০২ সালের আগ পর্যন্ত বিএসএফআইসি কর্তৃক এককভাবে চিনি উৎপাদন ও আমদানি করে দেশব্যাপী বিস্তৃত বিপণন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নির্ধারিত দরে সুষ্ঠু বিপণনের মাধ্যমে ভোক্তাসাধারণের স্বার্থ সংরক্ষণ করে এসেছে সরকার। ২০০২ সালে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে চিনি আমদানি অবাধ করা হয় (বিএসএফআইসি, ২০১৪ক)। বেসরকারি পর্যায়ে আমদানিকারকরা সাদা চিনি আমদানি করে বাজারজাত শুরু করে। পরে র-সুগার আমদানি করে পরিশোধিত চিনি উৎপাদনের জন্য সরকারের নিবন্ধিত ৬টি সুগার রিফাইনারি ২০০৪ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে উৎপাদনে আসে। এর মধ্যে চালু আছে ৫টি এবং এই ৫টি বেসরকারি রিফাইনারি প্রতিবছর উৎপাদন করতে পারে প্রায় ৩২ লাখ মেট্রিক টন চিনি (বিএসএফআইসি, ২০১৪)। (আনু মুহাম্মদ সম্পাদিত সর্বজন কথা থেকে নেয়া)