যুক্তরাষ্ট্রে আশঙ্কায় আরও কয়েকটি ব্যাংক দেউলিয়া সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক : বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা, আতঙ্কে গ্রাহকরা
এম. মোশাররফ হোসাইন : অন্যান্য বাণিজ্যেক ব্যাংকের মতো গত সপ্তাহেও বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি)। বর্তমান মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতে দেশটির অন্যান্য ব্যাংকের মতো এসভিবিও খানিকটা তারল্য সংকটে ভুগছিল, তবে তা একেবারেই নগণ্য।
কিন্তু তারপর মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে একদম দেউলিয়া হয়ে পড়েছে এসভিবি। শুক্রবার ব্যাংকের পরিচালনা কমিটির সদস্যরা দেশজুড়ে এসভিপির সমস্ত শাখা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। ব্যাংকটির এই অবস্থার মূল কারণ গুজব। বুধবার হঠাৎ চাউর হয়ে যায়, গুরুতর আর্থিক ঘাটতিতে ভুগছে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক। ঘাটতির পরিমাণ এতটাই যে ব্যাংকের ব্যালান্স শিটের কিনারা করতেই প্রয়োজন অন্তত ২২৫ কোটি ডলার।
এই গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর এসভিবি থেকে গ্রাহকদের টাকা তোলার হিড়িক পড়ে যায়। বুধবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার ভোররাত পর্যন্ত হাজার হাজার গ্রাহক নিজেদের ব্যাংক হিসাব খালি করে টাকা তুলে নেন এসভিবি থেকে। ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত বুধবার এসভিবির সবগুলো শাখায় মোট ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারেরও বেশি পরিমাণ অর্থ ছিল। কিন্তু গ্রাহকদের প্রায় সবাই টাকা তুলে নেওয়ার পর এখন অবশিষ্ট আছে মাত্র ৯৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার।
বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তির রাজধানী হিসেবে খ্যাত যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় সিলিকন ভ্যালিতে এই ব্যাংকের কর্তৃত্ব গ্রহণের সংবাদে শিল্পকারখানায় এক ধরনের হতাশা নেমে এসেছে। অজানা আতঙ্কে নিমজ্জিত হয়েছেন ব্যাংকের গ্রাহকরা। এ ব্যর্থতার জের হিসেবে অচিরেই আরও কয়েকটি ব্যাংকে তালা ঝুলতে পারে বলে অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এসভিবির এ ঘটনায় গত দুই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে হারিয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলার। এমনকি ইউরোপীয় ব্যাংকগুলো হারিয়েছে আরো ৫০ বিলিয়ন ডলার।
এসভিবির মোট সম্পদের পরিমাণ ২০৯ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের শেষ দিকে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১৭৩ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক ধসের ঘটনা। এর আগে ২০০৮ সালে ওয়াশিংটন মিউচুয়াল ব্যাংক আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। এসভিবির আকস্মিক এ পতনের ফলে বিশ্ববাজারে যে ধাক্কা লেগেছে, এতে আমানতকারী বিভিন্ন কোম্পানি ও বিনিয়োগকারীদের বিপুল পরিমাণের অর্থ আটকে পড়েছে। তবে এফডিআইসি বলছে, ব্যাংকের সম্পদ বিক্রি করে আমানতকারী ও পাওনাদারদের অর্থ পরিশোধ করা হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংকটির এ পতনের পেছনের আরো বেশকিছু বিষয়ের ভূমিকা রয়েছে। প্রধানত নগদ অর্থ সংকটের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার বৃদ্ধি, লোকসানে বন্ড বিক্রি, শেয়ার বিক্রির ঘোষণা এবং শেয়ার বিক্রিতে ধস নামার মতো উল্লেখযোগ্য কারণে এসভিবি বন্ধ হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের ধারাবাহিকভাবে নীতি সুদহার বৃদ্ধি। এত দিন মূলত মূল্যস্ফীতির মধ্যেই এর প্রভাব সীমিত ছিল। গত বছরের শুরুতেই ফেডের নীতি সুদহার ছিল শূন্যের কাছাকাছি। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেনজনিত মূল্যস্ফীতির প্রভাব মোকাবিলায় গত এক বছরে ফেড আটবার নীতি সুদহার বৃদ্ধি করেছে। ফলে বাণিজ্যিক ঋণের সুদহারও বেড়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে সে দেশের বন্ডের সুদহার বেড়েছে। ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্টার্টআপ কোম্পানিগুলো। বিনিয়োগকারীরা স্টার্টআপে বিনিয়োগ কমিয়ে দেওয়ায় সিলিকন ভ্যালির এ স্টার্টআপগুলো সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকে রক্ষিত আমানত ভেঙে খেতে শুরু করে। তাতে সিলিকন ভ্যালির ব্যাংকের আমানতে টান পড়ে। এ বাস্তবতায় এসভিবি গত বুধবার ২১ বিলিয়ন বা ২ হাজার ১০০ কোটি ডলারের বন্ড বিক্রি করে, যার সিংহভাগই ছিল মার্কিন ট্রেজারি বন্ড। এর সুদহার ছিল ১ দশমিক ৯ শতাংশ, অথচ ১০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের সুদহার প্রায় ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। ফলে বন্ড বিক্রি মুখ থুবড়ে পড়ে। তাদের ক্ষতি হয় ১৮০ কোটি ডলার।
এরপর সেই ক্ষতি পোষাতে বৃহস্পতিবার এসভিবি ২২৫ কোটি ডলার সমমূল্যের ইকুইটি বিক্রির ঘোষণা দেয়। বলা যায়, এটা ছিল কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার মতো। হুড়মুড়িয়ে আমানত তুলে নিতে শুরু করেন আমানতকারীরা। পতন হয় ৪০ বছরের পুরোনো এই ব্যাংকের।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এবং নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ বেন এস বার্নানকে বলেছেন, স্রেফ গুজবের কারণে যে ব্যাংক ধসে পড়তে পারে, তার বড় নজির এসভিবি। বিপুলসংখ্যক সঞ্চয়কারী যখন একসঙ্গে সঞ্চয় ভাঙার জন্য ব্যাংকে যান, তখন গুজব কার্যত বাস্তব রূপ লাভের কাছাকাছি চলে যায়।
১৯৮৩ সালে যাত্রা শুরু করে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক, শুরুতে এটির নাম ছিল ক্যালিফোর্নিয়া ব্যাংক। যাত্রা শুরুর পর গত দশকে ব্যাংকটির বিস্তার ঘটে সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও বাইরের বিভিন্ন দেশে ৮ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি কর্মী আছে এসভিবির। এই কর্মীদের অধিকাংশই অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শাখার। এমন অবস্থার প্রভাব পড়েছে শেয়ার মার্কেটে। উদ্বেগ-আতঙ্ক তৈরি হয়েছে বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কায়। আর এর জের গোটাবিশ্বে অর্থনৈতিক সেক্টরে বাজে প্রভাব ফেলতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে।