১০ টাকা কেজি চাল : মহৎ কাজের করুণ পরিণতির শঙ্কা
একটি কথা ভুলে গেলে চলবে নাÑ চরিত্রের পরিবর্তন না হলে এই অভাগা দেশের ভাগ্য ফেরানো যাবে কিনা সন্দেহ। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে থেকে আমাদের সকলকে আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি করতে হবে।’ শেখ হাসিনাও তার রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সকল কাজে আত্মশুদ্ধি ও চরিত্রনিষ্ঠার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বর্তমান সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সে আলোকে আইনকানুন, নিয়মনীতি, পরিকল্পনা ও বিভিন্ন কৌশল প্রণয়ন করা হয়েছে এবং তা বাস্তবায়ন অব্যাহত আছে; দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদপে গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কেবল রাষ্ট্রীয় নিয়মনীতি, আইনকানুন প্রণয়ন ও প্রয়োগই যথেষ্ট নয়; তার জন্য সামগ্রিক এবং নিরবিচ্ছিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ প্রয়োজন। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সামগ্রিক উদ্যোগের সহায়ক কৌশল হিসেবে ‘সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়: জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল’ প্রণয়ন করা হয়েছে।
এই কৌশলটি বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ এবং বেসরকারি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। চরিত্রনিষ্ঠা আনয়নের জন্য মানুষের জীবনের একেবারে গোড়া থেকে, পরিবার ও শিাপ্রতিষ্ঠান থেকেই কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। রাজনীতিতেও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘নেশন মাস্ট বি ইউনাইটেড অ্যাগেইনস্ট করাপশন। পাবলিক ওপিনিয়ন মবিলাইজ না করলে শুধু আইন দিয়ে করাপশন বন্ধ করা যাবে না।’ স্বাধীনতার পর থেকেই দুর্নীতি দমন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ল্েয বিভিন্ন সময় বহুবিধ আইন, বিধিবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর আরো কিছু নতুন আইন প্রণয়ন করেছে, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার উন্নয়নে বেশকিছু নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে এবং এগুলোর ব্যবস্থাপনা ও পদ্ধতির উন্নয়ন সাধন করা হয়েছে। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১১-২০১৫) শেখ হাসিনা সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি দমনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়নের ল্েয প্রণীত ‘বাংলাদেশের পরিপ্রেতি পরিকল্পনা ২০১০-২০২১’ শীর্ষক দলিলে দুর্নীতি দমনকে একটি আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। এই আন্দোলনে সবাইকে অংশীদার হতে উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া দুর্নীতি দমনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সম যেসব আইনগত মহাজোট সরকারের সময় প্রণীত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯’, ‘তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯’, ‘ভোক্তা অধিকার সংরণ আইন, ২০০৯’, ‘সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন, ২০০৯’, ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯’, ‘চার্টার্ড সেক্রেটারিজ আইন, ২০১০’, ‘জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরা প্রদান) আইন, ২০১১’, ‘মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২’, ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২’, ‘প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২’ ইত্যাদি। এসব আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে দুর্নীতিমুক্ত রাখার প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, দুর্নীতি প্রতিরোধের বিধান ব্রিটিশ আমল থেকেই চালু রয়েছে। ১৮৬০ সালের চবহধষ ঈড়ফব-এ দুর্নীতি প্রতিরোধের বিধান আছে। ১৯৪৭ সালে দুর্নীতি দমন আইন পাশ হয়। ২০০৪ সালের ৫ নম্বর আইনে ‘দেশে দুর্নীতি ও দুর্নীতিমূলক কার্য প্রতিরোধের ল্েয দুর্নীতি ও অন্যান্য সুনির্দিষ্ট অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনার জন্য একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান’ প্রণীত হয়। এই আইনের আওতায় যেসব কার্য অপরাধ বলে বিবেচিত হয় তা হলোÑ ‘(ক) ঞযব চৎবাবহঃরড়হ ড়ভ ঈড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ অপঃ, ১৯৪৭ (অপঃ ১১ ড়ভ ১৯৪৭)-এর অধীন শাস্তিযোগ্য অপরাধ; (খ) ঞযব চবহধষ ঈ ড়ফব ১৮৬০ (অপঃ ঢখঠ ড়ভ ১৮৬০)-এর ংবপঃরড়হং ১৬১-১৬৯, ২১৭, ২১৮, ৪০৮, ৪০৯ ধহফ ৪৭৭অ-এর অধীন শাস্তিযোগ্য অপরাধসমূহ;’ এবং এসব অপরাধের সঙ্গে সংযুক্ত সহায়তাকারী ও ষড়যন্ত্রমূলক ও প্রচেষ্টামূলক অপরাধকার্য। পূর্বে উল্লিখিত ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২’-এর আওতাধীন অপরাধও দুর্নীতি হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু দুর্নীতিকে কেবল আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে দমন করা সম্ভব নয়, তার জন্য প্রয়োজন সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। এজন্য সরকারি কর্মকর্তা, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, সুশীল সমাজ ও নাগরিকগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রয়াস দরকার।
৪. বাংলাদেশ জাতিসংঘের টহরঃবফ ঘধঃরড়হং ঈড়হাবহঃরড়হ অমধরহংঃ ঈড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ (টঘঈঅঈ)-এর অনুসমর্থনকারী দেশ। দুর্নীতি নির্মূলের জন্য ‘ফৌজদারি আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ ও আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে দুর্নীতির প্রতিকার ছাড়াও দুর্নীতির ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণকে’ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এই কনভেনশনে। আগামী এক দশকে এ দেশে ক্ষুধা, বেকারত্ব, অশিা, বঞ্চনা ও দারিদ্র্য থাকবে না। দেশে বিরাজ করবে সুখ, শান্তি, সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধি। সংবিধানের প্রস্তাবনা অনুযায়ী গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ‘এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা’ হবে, ‘যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত’ হবে। এই ল্য পূরণে সুশাসন প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রের অবশ্য-কর্তব্য এবং সেই সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি দমন একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য পরাকৌশল। কেবল আইন প্রয়োগ ও শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব নয়, তার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক েেত্র একটি আন্দোলন গড়ে তোলা, যাতে নাগরিকগণ চরিত্রনিষ্ঠ হয়, রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ও সুশীল সমাজের প্রতিষ্ঠানসমূহে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা পায়।
১০ কেজি চাল বিতরণের অনিয়ম তথা দেশের অন্য সব দুর্নীতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমাদের করণীয় হলোÑ মানুষকে নৈতিক জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করা। সততা দ্বারা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষ যেন একজন মানুষ অনুসরণ করে চলেন। তার যেন সমাজের কালোত্তীর্ণ মানদ-, নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্য থাকে। দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যক্তি-পর্যায়ে কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা, তথা চরিত্রনিষ্ঠা খুব দরকার। এজন্য বিদ্যমান আইনকানুন, নিয়মনীতির সঙ্গে দুর্নীতি দমনকে একটি আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করতে হবে। সেই অঙ্গীকারকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের ল্েয সরকারের সদিচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে জনগণের প্রচেষ্টা গুরুত্ববহ।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান