আমেরিকার আদিবসতি
সিরাজ ইসলাম
প্রাচীন আমেরিকার এই মহাসভ্যতা কবে কীভাবে এতটা উন্নতিতে পৌছে সহসা এমন নিঃশেষ হয়ে গেলো, তা বুঝতে হলে আমাদের প্রাচীন প্রারম্ভে ফিরে যেতে হবে। অতি আদিম সূচনা থেকে যাত্রা শুরু করে স্থানীয় অধিবাসীদের এই ধাপে ধাপে সভ্যতায় উত্তরণ নিঃসন্দেহে মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক আশ্চর্যতম ঘটনা। অন্যদিকে তাদের গোটা ইতিহাসই যেন আবার একপ্রকার ধোঁয়াশায় দুর্বোধ্য। প্রায়শ স্ববিরোধে বিতর্কিত এমনকি তাদের চরম উন্নতিগুলোও। যেমন পেরু-সভ্যতা প্রশাসনে এতটা উৎকৃষ্ট হলেও তাদের নিজস্ব লেখনরীতির কোনো নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া মেক্সিকো থেকে কষ্টারিকা পর্যন্ত মধ্য আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাপ্ত লিপিগুলোরও অদ্যাবধি কোনো মর্মোদ্ধার সম্ভব হয়নি। স্পেনীয়দের ‘স্বচক্ষের বর্ণনা’গুলোয় প্রচুর গোলমাল ছিলো নিশ্চয়। তবু অন্য বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাচীন আমেরিকানদের সম্পর্কে ইতোমধ্যে অনেকটাই জানা গেছে। এবং ক্রমাগত জানা যাচ্ছে প্রতœতাত্তি¡ক গবেষণার সঙ্গে-সঙ্গে নিয়মিত নিত্য নতুন তথ্য। এসবের ভিত্তিতে এখন একথা নিশ্চিত বলা যায় যে, কলম্বাসের বহু শ’ বছর আগে থেকে প্রাচীন আমেরিকায় বাস করেছে অনেক বড়বড় জাতি এবং সেইসঙ্গে স্বভাবতই অসংখ্য অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষ। এখন ধীরে ধীরে কিছুটা হলেও জানা যাচ্ছে তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, রীতিনীতি।
আধুনিক গবেষণায় একটা সত্য সুপ্রমাণিত হয়েছে। নতুন বিশ্বে তথা দুই আমেরিকা মহাদেশে মানুষ গোড়াতে স্থানীয় নয়, বহিরাগত। এখানে কোনো নর-বানরের করোটি বা কংকালাংশ বা অনুরূপ কোনো প্রকার চিহ্নের সন্ধান মেলেনি। খুঁজে পাওয়া যায়নি এমনকি জাভা মানুষ বা পিকিং মানুষ গোছের কোনো আদিম মানবেরও ভগ্নাবশেষ। অর্থাৎ আধুনিক মানুষ তথা হোমো সেপিয়েন্সদেরই একটি গোষ্ঠী আমেরিকার ইন্ডিয়ানরা, যাদের উৎপত্তি নিশ্চয় পুরনো বিশ্বে তথা আফ্রো-ইউরেশীয় মহাভ‚খন্ডে। এদের আমেরিকায় পদার্পণ ঘটেছিলো সম্ভবত প্লাইস্টোসিন বা হিমযুগের শেষদিকে। যখন বাসগৃহ, বস্ত্র ও আসবাবপত্র সহ কৃষিযুগের নানা প্রয়োজনীয় উপকরণ মানুষ ইতোমধ্যে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। এর ফলে তারা কোনক্রমে টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছে সম্ভবত নতুন দেশের তীব্র ঠান্ডা আবহাওয়াতেও। সাইবেরিয়ার বেরিংপ্রণালী ও আলাস্কা পেরিয়েই তারা আমেরিকায় এসেছিলো নিশ্চয়। বোধ হয় শত্রæতাড়িত হয়ে বা দুর্ভিক্ষের তাড়নায় ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তারা সুদূর দুর্গম পথে তাদের যাত্রা শুরু করে। এমন হতে পারে যে, তারা নৌকা বা ডোঙ্গা জাতীয় কিছু ব্যবহার করেছিলো। অথবা হয়ত ঘোর শীতে বেরিংপ্রণালী যখন কঠিন বরফ হয়ে থাকত, তখন পায়ে হেটেই ওই জলপথ অতিক্রম করেছিলো। এই উদ্বাস্তুরা বেরিংপ্রণালী পেরিয়ে সম্ভবত আলাস্কা ও পশ্চিম কানাডার তুষারমুক্ত অঞ্চলে বহুশ’ বছর বাস করে। পরে হিমবাহের ধাক্কায় বরফের কোনো পথ খুলে গেলে সেই পথ ধরে ক্রমশ চলে আসে দক্ষিণে। মনে হয়, বহুবার বহুদিন ধরে চলে এই প্রক্রিয়া। এর ফলে সাইবেরিয়া থেকে আগত বহুসংখ্যক মানবজাতি-তরঙ্গ নতুন বিশ্বে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে নিতে সক্ষম হয়। এই অভিযাত্রীদেরকে আধুনিক অর্থে ঠিক মোঙ্গলীয় বলা যায় না। যেহেতু তখনো সত্যিকার মোঙ্গলীয় নরগোষ্ঠীর উদভবই হয়নি। অথবা হলেও তারা তখনো অন্তত পূর্ব সাইবেরিয়া পর্যন্ত পৌছয়নি।
দৈহিক বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে এই অভিযাত্রীরা সম্ভবত মোঙ্গলীয়দের থেকে বেশ আলাদা কোনো গোষ্ঠী ছিলো। সাধারণভাবে বেরিংপ্রণালী থেকে যত দূরে যাদের বসবাস, তাদের আকৃতিতে মোঙ্গলীয়দের চেয়ে ততবেশি পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বেশি দূরের অঞ্চলসমূহে এদের অনেকের দীর্ঘমুÐু, খাড়া নাক ও তরঙ্গিত কেশ মোঙ্গলীয়দের সঙ্গে স্পষ্ট ভিন্নতা নির্দেশ করে। অনেকটা পরবর্তীকালে বেরিংপ্রণালী পেরিয়ে আসার কারণে এস্কিমোদের সঙ্গেই মোঙ্গলীয় চেহারার সর্বাপেক্ষা বেশি সাদৃশ্য দেখা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এরা সবাই আদিতে একজাতি ছিলো, যদিও পরিবেশের বৈচিত্র্যের পাশাপাশি জেনেটিক ড্রিফট দেহের জিনে প্রাজননিক রূপান্তর সৃষ্টির মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় মানুষের চেহারায় বিভিন্নতা এনে দেয়। চেহারায় জলবায়ুর প্রভাব একটা পর্যবেক্ষিত সত্য। যেমন আমেরিকান আদি বাসিন্দাদের ভিতর শীতপ্রধান এলাকার অধিবাসীরা অপেক্ষাকৃত দীর্ঘদেহী।
প্রাচীন আমেরিকায় মানব প্রজাতির প্রথম পদার্পণের সময়কাল নির্ণয় বেশ দুরূহ। এক্ষেত্রে এযাবৎকালের বিশেষ উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হচ্ছে পশুরক্তচিহ্ন-মাখা একটা পাথরের ফলা। কার্বন-১৪ পরীক্ষার সাহায্যে এই রক্তচিহ্নকে বারো হাজার বছর আগের বলে শনাক্ত করা গেছে। তবে পাথরের এই ফলাটি ছুঁচালো। অন্যদিকে আমেরিকা মহাদেশে ভোতা অগ্রভাগের প্রচুর ফলা আবিষ্কৃত হওয়া থেকে মনে হয়, সম্ভবত এগুলোর ব্যবহারকারীদের এখানে আগমন ঘটে কমপক্ষে বিশ ত্রিশ হাজার বছরের আগে। অবশ্য এ-ও সম্ভব যে, সব ফলা হয়ত সর্বদা তারা ছুঁচালো করত না। সেক্ষেত্রেও তাদের প্রাচীনত্ব কমপক্ষে বারো হাজার বছরের। সংকীর্ণ দুর্গম কোন অঞ্চলে বাস করত হয়ত অল্প কিছুসংখ্যক মানুষ। হিমবাহের তাড়া থেকে কোনো প্রকার মুক্তি পেয়ে বাইরে এসেই তারা দেখে চমৎকার সজীব প্রকৃতি। আর এমন সব নিরীহ বুনো প্রাণী, মানুষের হিংস্রতার সঙ্গে যাদের পরিচয়ের তখন সবে শুরু। আগে পশু শিকারে বেশ বেগ পেতে হত। এবার সেটা সহজ হয়ে এলো। খৃষ্টপূর্ব দশ হাজারের দিকে পরিবেশ তাদের পক্ষে অনুক‚ল হতে থাকে। তার প্রধান প্রমাণ আবিষ্কৃত অজস্র ক্লভিস পয়েন্ট বা ছুঁচালো বর্শাফলক, যা দিয়ে তারা ম্যামথ ও বাইসন হত্যা করে খেত। এভাবে বহুকাল কেটে গেলো।
এরপর খৃষ্টপূর্ব সাত হাজারের কাছাকাছি সময়ে হিমবাহের বেগ নেমে আসে। খৃষ্টপূর্ব পাঁচ হাজারের দিকে জলবায়ু অনেকটা উষ্ণ হয়ে ওঠায় আমেরিকার এই আদিবাসীদের জীবন ক্রমশ সতেজ হয়ে ওঠে। মুক্ত হতে থাকে নানাদিকে তাদের বিচরণ। ভ‚খন্ডের চেহারা পাল্টাতে থাকে ধীরে ধীরে। নদী শুকিয়ে গিয়ে মরুময়তা বাড়ে।
জায়গায় জায়গায় কাঁটাযুক্ত ফণীমনসা গাছ গজায়, যা আগে ছিলো তৃণ-জঙ্গলে ঠাসা। ভ‚গোল ও জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যের কারণে উত্তরদিকে ও মহাসমতলে লোকেরা অনেকটা আদিম থেকে যায়। অন্যদিকে পশ্চিমে ও মেক্সিকোয় ইন্ডিয়ানরা উন্নততর জীবন গঠনে মন দেয়। মেক্সিকো ও দক্ষিণে কৃষির বিস্তার হওয়ায় উদ্ভিজ্জভোজিতা বৃদ্ধি পায়। কৃষির প্রথমদিকে মরিচ, কুমড়ো ও লাউ ফলানো হত। লাউয়ের ব্যবহার হত পাত্র হিসেবেও। অন্যান্য উদ্ভিজ্জদ্রব্য তারা তখন অরণ্য থেকে কুড়িয়ে নিত। পরবর্তীকালে লাল ও হলুদ শিমসহ আরও নানা তরিতরকারি ফলানো হতে থাকে।
তবে খৃষ্টপূর্ব আড়াই হাজারের দিকে ব্যাপক চাষাবাদ শুরু হয়, প্রধানত ভুট্টাচাষের মাধ্যমে, মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকায়। অন্যত্রও কৃষি ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর সবদেশের আদিম চাষীদের দ্বারা অনুসৃত ‘বৃক্ষছেদন ও প্রজ্জ্বলন’ তথা ¯øাশ-অ্যান্ড-বার্ন পদ্ধতিতেই তখনো চাষাবাদ চলত। খৃষ্টপূর্ব দু’হাজারের দিকে তারা সুগঠিত গৃহনির্মাণ করতে থাকে, বাঁশ সাজিয়ে বেতের বুনুনিতে বেঁধে তার উপরে কাঁদা লেপে। ঘাস, তালপাতা ইত্যাদি দিয়ে তারা ছাদ রচনা করত অনেকটা কুঁড়েঘরের কায়দায়। এ গৃহগুলো ছিলো গরম আবহাওয়ায় চমৎকার উপযোগী। আজো অনেক রেড ইন্ডিয়ান গোত্র এধরনের বাড়ি নির্মাণ করে থাকে। সাংস্কৃতিক অগ্রগতির প্রথম দিককার নিদর্শন ছিলো পাত্রাদি, যা দু’হাজার খৃষ্টপূর্বের আগেও নির্মিত হত। এর সামান্য পরবর্তী যুগের অসংখ্য মাটির মূর্তি পাওয়া গেছে মেক্সিকো এলাকায়। এগুলো বর্তমানে নৃতাত্তি¡কদের গবেষণা ও পর্যটকদের আকর্ষণের সামগ্রী। সাধারণত সুন্দরী নারীদের প্রতিকৃতি এই মৃৎপুত্তলিকাগুলো চার-পাঁচ ইঞ্চি লম্বা হত। প্রথমযুগের নমুনাগুলো ছিলো নগ্ন নারীমূর্তি, পরবর্তীকালে নেংটিপরা পুরুষমূর্তি এবং তারপরে পরিহিতা নারীমূর্তি। এরা সময়ের বিবর্তন নির্দেশ করে। মনে হয় আদি নারীমূর্তিগুলো উর্বরতা ও প্রজনন-সম্পর্কিত কুসংস্কারের সঙ্গে জড়িত ছিলো।
দু’হাজার থেকে একহাজার খৃষ্টপূর্বে কৃষিনির্ভর গ্রামগুলোর ক্রমশ উন্নতি হয় এবং অধিবাসীরা নবনব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তারা উন্নততর পাত্রাদি ও কৃষি সরঞ্জাম নির্মাণ করতে থাকে এবং কৃষির আরও উন্নতি হয়। মধ্য মেক্সিকো থেকে দক্ষিণ পেরু পর্যন্ত চার হাজার মাইলেরও বেশি দীর্ঘ অঞ্চলে ক্রমশ তারা সুদৃঢ় পত্তনি গেড়ে বসে। এরপর নগরভিত্তিক সভ্যতার উন্মেষ হয় এবং কালক্রমে বৈষয়িক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তারা বিপুল অগ্রগতির পরিচয় দেয়। ফেসবুক থেকে